পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর সবুজবাগ থানার সোর্স মো. তুষার এবং মাদকাসক্ত যুবক রিফাত ও সজীবের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী কিশোরী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে চিকিৎসাধীন। সে কোনো পুরুষ দেখলেই এখন আঁতকে উঠছে বলে জানিয়েছেন তার স্বজনরা।
১ জানুয়ারি দিনগত মধ্যরাতে হত্যার হুমকি দিয়ে সবুজবাগের পূর্ব রাজারবাগ হিন্দুপাড়ায় কাদিরের বাড়িতে ১৩ বছর বয়সী ওই কিশোরীকে গণধর্ষণ করা হয় বলে জানিয়েছেন মেয়েটির স্বজনরা। তারা অভিযোগ করেন, ভুক্তভোগী কিশোরী ও তার মা থানায় মামলা করতে গেলে তাদের ২৪ ঘণ্টা সেখানে বসিয়ে রাখার পর মামলা গ্রহণ করে পুলিশ। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলাটি করেছেন কিশোরীর মা।
ভুক্তভোগী মেয়েটির বরাত দিয়ে তার মা আমাদের সময়কে জানান, সবুজবাগের দক্ষিণ মাদারটেক বাজার রোড এলাকার একটি বাড়িতে সপরিবারে থাকেন তারা। তার স্বামী পেশায় রিকশাচালক। স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এবার প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটি। ফল আনতে ১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে স্কুলে যায় ওই কিশোরী। বেলা সাড়ে ১১টায় কম্পিউটারের দোকান থেকে পরীক্ষার ফল উঠিয়ে সে বাসায় ফিরছিল। পথে পূর্বপরিচিত তরুণ রিফাত তার ফল দেখতে চায়। কার্ড হাতে পেয়েই রিফাত মেয়েটিকে শর্ত দেয়- তার সঙ্গে ঘুরতে গেলে তবেই ফেরত দেওয়া হবে রেজাল্ট কার্ড।
অনেক অনুরোধ করেও কাজ না হওয়ায় রিফাতের শর্তে রাজি হয় মেয়েটি। মাদারটেকের আদর্শপাড়ায় গিয়ে মেয়েটিকে সেভেন-আপ দেয় রিফাত। গ্লাসে দেওয়া ওই পানীয় পান করার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মেয়েটি। প্রায় অচেতন অবস্থায় সেখানে একটি বাড়িতে মেয়েটিকে নিয়ে যায় রিফাত। এরপর আর কিছু মনে নেই তার। রাত ৮টার দিকে কিছুটা চেতনা ফিরে এলে মেয়েটি নিজেকে আবিষ্কার করে মাদারটেকের নতুনপাড়ার একটি মাঠে। সেখান থেকে মেয়েটিকে ওই এলাকারই আরেকটি বাসায় রেখে চলে যায় রিফাত। ওই বাসার এক তরুণী পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ভুক্তভোগী মেয়েটিকে বলে- রিফাত ভালো না, তোমার আরও সর্বনাশ হবে, তুমি পালিয়ে যাও। ওই তরুণী তার বোরকা পরিয়ে মেয়েটিকে তার বাসা থেকে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। কিন্তু পানীয়তে মেশানো নেশাজাতীয় দ্রব্যের ঘোর না কাটায় বেশিদূর যেতে পারেনি মেয়েটি। এরই মধ্যে রাস্তায় হঠাৎ পেছন থেকে তাকে টেনে ধরে রিফাত। ছেড়ে দেওয়ার অনেক অনুরোধ করা হলেও রিফাতের হাত থেকে রেহাই মেলে না। প্রায় অচেতন অবস্থাতেই তাকে ফের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। রাত ৩টার দিকে নতুনপাড়া পাওয়ার হাউসের মাঠের কাছে টহল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রিফাত ও মেয়েটি। এ সময়ও ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু করছিল তার।
মেয়েটির মা আরও জানান, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মাঝেই সোর্স তুষার দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কিছু একটা বলে। এরপর পুলিশ মেয়েটিকে থানায় না নিয়ে অথবা অভিভাবকদের জিম্মায় না দিয়ে তুলে দেয় তুষারের হাতে। পুলিশের হাত থেকে মেয়েটিকে ছাড়িয়ে সোর্স তুষার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝিলের পাশে চলে যায় রিফাত ও মেয়েটিকে নিয়ে যায়। সেখানে মেয়েটিকে ধর্ষণের চেষ্টা চালালে প্রায় অচেতন মেয়েটি হাত জোড় করে অনুনয় বিনয় করে। কিন্তু এর পরও রেহাই পায়নি। তুষারের কথায় রাজি না হলে গলা কেটে ঝিলে ভাসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে কিশোরীকে পার্শ্ববর্তী হিন্দুপাড়ার একটি টিনের ঘরে নিয়ে যায় তুষার, রিফাত ও সজীব। সেখানে পালাক্রমে চালানো ধর্ষণে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মেয়েটি। ভোরে নিজেকে সে আবিষ্কার করে ঘটনাস্থলের পাশেই একটি মাঠে, একা। একপর্যায়ে স্থানীয় এক নারী তার বিধ্বস্ত অবস্থা দেখতে পেয়ে নিয়ে যায় নিজ বাসায়।
এ দিকে মেয়ে রাতে না ফেরায় দিশেহারা হয়ে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন তার মা-বাবা। না পেয়ে স্বজন ও স্থানীয়দেরও জানানো হয়। ভুক্তভোগীর এক বান্ধবী জানায়, মেয়েটিকে ১ জানুয়ারি দুপুরে তিনি রিফাতের সঙ্গে যেতে দেখেছেন। এ তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন হিসেবে রিফাতকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন স্থানীয়রা। প্রথমে সে অস্বীকার করলেও মারধর শুরু হলে সে সব কথা বলে দেয়। তাকে সঙ্গে নিয়েই হিন্দুপাড়ার ওই নারীর বাসা থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। এর পর মেয়েটিকে নিয়ে ওর মা সবুজবাগ থানায় যান আইনি পদক্ষেপ নিতে। কিন্তু থানার পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েটির চিকিৎসার জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। উপরন্তু ভুক্তভোগী ও তার মাকে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বসিয়ে রাখা হয়। পরে স্থানীয়দের চাপের মুখে মেয়েটিকে ওসিসিতে পাঠায় পুলিশ; রিফাতের দেওয়া তথ্যানুসারে সোর্স তুষার ও মাদকাসক্ত যুবক সজীবকে আটক করা হয়। এর আগে, পুলিশ রাতে মেয়েটিকে থানায় নিয়ে গেলে অথবা তার অভিভাবকদের হাতে তুলে দিলে সে গণধর্ষণের শিকার হতো না। সোর্সের হাতে তুলে দেওয়ার অন্যায় সিদ্ধান্তের কারণে মেয়েটির সর্বনাশ হয়ে গেল।
এই যখন অবস্থা, তখন মামলার বাদী মেয়েটির মা বলছেন, ‘সুন্দর তদন্তের’ কথা বলেও পুলিশের একজন তাদের কাছে টাকা চেয়েছেন।
এ দিকে বাদী তার মেয়েকে গণধর্ষণ করার অভিযোগ করলেও মামলায় একজনকে ধর্ষক (তুষার) ও অন্য দুজনকে ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে আসামি করা হয়েছে। কেন? এ প্রশ্নে মেয়েটির মা এ প্রতিবেদককে বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না, পুলিশকে ঘটনার বিস্তারিত বলেছি। তারাই এজাহার লিখেছেন। আমাকে সই করতে বলেছে, আমি শুধু সই করছি। এজাহারে পুরো ঘটনার উল্লেখ নেই জেনে অবাক হন তিনি।
সুত্রঃ আমাদের সময়