রাজশাহী নগরীর শিরোইল কলোনির বাসিন্দা রিকশাচালক জয়নাল। স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা থাকেন। জয়নাল বয়সের কারণে রিকশা চালানো বাদ দিয়েছিলেন। স্ত্রী আশা বেগমও গোদ রোগে আক্রান্ত। ফলে সংসার ও মায়ের চিকিৎসার জন্য পড়ালেখা ছেড়ে রিকশা চালাতে শুরু করেন ছোট ছেলে বাপ্পি। কিন্তু বিধি বাম! সেই বাপ্পি এখন কারাগারে। তাকে মুক্ত করতে টাকার প্রয়োজন। এজন্য অসুস্থ আশা বেগম কাজ নিয়েছেন অন্যের বাড়িতে। আর ছেলেকে মুক্ত করতে বৃদ্ধ বয়সে পেডেলে পা রেখেছেন জয়নাল।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে খুন হওয়া যুবলীগ কর্মী রাসেল হত্যা মামলার আসামির নামের সঙ্গে মিল থাকায় নিরাপরাধ হওয়ার পরেও আড়াই মাস ধরে কারাভোগ করছেন বাপ্পি।
শুধু জয়নালের পরিবারই নয়, শিরোইল কলোনির আরও পাঁচটি পরিবারের প্রায় একই দশা। পরিবারগুলোর সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশের ‘ভুলে’ তাদের সন্তানরা আজ হত্যা মামলার আসামি। তারা নিজেদের ‘নিরপরাধ’ সন্তানদের মামলা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান।
জানা যায়, গত বছরের ১৩ নভেম্বর পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও মহানগর বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় খুন হন যুবলীগকর্মী সানোয়ার হোসেন রাসেল। এ ঘটনায় রাসেলের ভাই মনোয়ার হোসেন রনি বাদী হয়ে ওইদিন রাতে নগরীর চন্দ্রিমা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৭-৮ জনকে আসামি করা হয়।
তবে মামলা হওয়ার আগেই ঘটনার দিন সন্ধ্যায় পুলিশ শিরোইল কলোনি থেকে জয়নাল আবেদীনের ছেলে বাপ্পি (১৯), নুর মোহাম্মদ সরদারের ছেলে মো. শাহীনুর (২৪), মানিক মিয়ার ছেলে শুভ (২১), বাবু ইসলামের ছেলে চঞ্চল (১৯), মো. জালাল উদ্দীনের ছেলে মো. কালাম উদ্দীন, আবুল কালাম চৌধুরীর ছেলে মো. মোজাহিদুল ইসলাম অভ্রকে আটক করে। পরে তাদেরকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
এদের মধ্যে কালাম ও অভ্র গত বছর জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। কিন্তু গ্রেফতার হওয়ায় একটি পরীক্ষা দিতে পারেনি। তাদের বয়স ১৫ বছর হলেও এজাহারে ১৯ বছর দেখানো হয়। পরে তারা দু’জন কিশোর আদালত থেকে জামিন পায়।
এছাড়া মামলার এজহারে মো.শাহিনের নাম উল্লেখ থাকলেও পুলিশ গ্রেফতার করেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের সান্ধ্যকোর্সের শিক্ষার্থী শাহীনুরকে।
গত ২৯ জানুয়ারি সরেজমিনে শিরোইল কলোনিতে গেলে কারাগারে থাকা চার তরুণের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
বাপ্পির মা আশা বেগম বলেন, ‘আমার বেটা সংসার চালাইতো। মার্ডারের দিন ও ঘরেই ছিল। সন্ধ্যায় মোড়ের সামনে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো। পুলিশ আসল বাপ্পিকে না ধরে আমার বেটাকে নিয়ে গেছে। পুলিশ আমাদের কথা শুনছেই না। জেলহাজতে গেলে টাকা লাগে। আমি গরীব মানুষ, পায়ের রোগের জন্য হাঁটতেও পারি না। তবু ছেলের জন্য অন্যের বাড়িতে কাজ করছি। বেটার বাপেরও বয়স হইছে, কাজ করতে পারে না। কিন্তু টাকার জন্য রিকশা চালায়। রিকশার লাইসেন্স না থাকায় শহরেও যেতে পারে না। বাবা তোমরা সাংবাদিক, আমার ছেলের জন্য কিছু করো,’ বলেই দু’চোখের পানি ছেড়ে দেন আশা।
এসময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শুভর বাবা মানিক মিয়া অনেকটা হতাশার সুরে বলেন, ‘আমার বেটার কোনও দোষ নেই। বাপ্পির সঙ্গে বসে ছিল মোড়ের ওপর। পুলিশ বাপ্পির সঙ্গে যারা ছিল সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।’
মানিক মিয়া আরও বলেন, ‘আমি একজন টিকিট মাস্টার, দিনে তিনশ’ টাকা বেতন পাই। এ টাকা দিয়ে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। তার ওপর স্থানীয় কোর্ট থেকে ছেলের জামিন না হওয়ায় উকিল বলেছে হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে। এর জন্য লাখ টাকা লাগবে, এত টাকা কোথায় পাবো? এই চিন্তায় আমার গত দুই মাস ধরে ঘুম নাই।’
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহীনুরের মামা অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট সাইফুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন শাহীনুর ইন্টার্নশিপের কাজে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছিলেন। সন্ধ্যায় রাজশাহীতে ফিরে কলোনির একটি দোকানে শেভ করাচ্ছিল। সেখান থেকে পুলিশ তাকে আটক করে। বিষয়টি জানতে পেরে থানায় যান সাইফুল ইসলাম এবং শাহীনুরকে আটকের কারণ জানতে চান। পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে সাইফুল ইসলামের তর্কও হয়। পরে বাকিদের পরিবারের লোকেরা থানায় গেলে পুলিশ আটকদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। রাত ১২টার দিকে মনোয়ার হোসেন রনি থানায় গিয়ে মামলা দায়ের করেন। এসময় পুলিশ কৌশলে আটকদের বাবা-মা’র নাম জেনে তা এজাহারে দিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চন্দ্রিমা থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘মামলার এজাহারে যাদের নাম ছিল তাদেরকেই গ্রেফতার করা হয়েছে।’
এসময় মামলার আগেই আটকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন করেও তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, ঘটনার পর থেকে বাদীর সঙ্গে একাধিকবার তারা যোগাযোগ করেছেন। বাদী এজাহার থেকে তাদের সন্তানদের নাম মুছে দেবেন বললেও এখনও তা করেননি।
জানা যায়, রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর এলাকাবাসী নগর জুড়ে পোস্টার সাঁটায়। পোস্টারে হত্যাকাণ্ডে জড়িত দাবি করে বাপ্পি, শাহিনসহ আট জনের নাম ও ছবি ছাপানো হয়। সেখানে গ্রেফতার শাহীনুর, বাপ্পি, শুভ, চঞ্চল কারো ছবি নেই।
এলাকাবাসী ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের স্থানের আশপাশে বেশ কয়েকটি সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেখানে হামলাকারীদের ছবি সংরক্ষিত আছে। কিন্তু পুলিশের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। নিরপরাধ ও নিরীহদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।
তারা অভিযোগ করছেন, মূল আসামিদের আড়াল করতেই পরিকল্পিতভাবে পুলিশ এমনটা করেছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন,ঘটনার দিন মধ্যরাতে থানায় মামলা হলেও এরআগে সন্ধ্যাতেই ওই ছয়জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাদের নামে মামলা হয়।
মামলার বাদী মনোয়ার হোসেন রনি বলেন, ‘ঘটনার দিন রাতে মামলা দায়ের করেছিলাম। কিন্তু মামলার মূল আসামিরা কেউ এখনও গ্রেফতার হয়নি।’
গ্রেফতাররা আসল আসামি কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি প্রশাসনকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি কিছু বলতে পারবো না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন,‘মামলার তদন্ততো আর গ্রেফতারদের পরিবার করবে না, যারা তদন্ত করছে তারাই এই বিষয়টি ভালো বুঝেছে।’
তবে মামলা হওয়ার আগে তাদেরকে কেন আটক করা হয়েছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কিছু জানেন না বলে মন্তব্য করে ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন