দিল্লিতে গেরুয়া সন্ত্রাসীদের আগুনে তাঁরা বাড়ি হারিয়েছেন। আশ্রয় ছিল ক্যাম্প। করোনা সেই ক্যাম্পও কেড়ে নিল। এ বার কোথায় যাবেন তাঁরা? খবর-ডয়চে ভেলে
আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ক্যাম্প
অন্ধকার, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
কতদিন এ ভাবে থাকতে হবে ক্যাম্পে? এরপর কোথায় যাবেন? বাড়ি সারাইয়ের টাকা কোথা থেকে আসবে? কিচ্ছু জানেন না ওঁরা। চোখ বন্ধ করলেই এখনও আগুনের দৃশ্য ভেসে আসছে বার বার।
মানসিক অসুখ
ক্যাম্পের চিকিৎসকদের বক্তব্য, অধিকাংশ মানুষ ট্রমায় ভুগছেন। তাঁদের কাউন্সেলিং প্রয়োজন।
দু’চোখ ভরা জল। গেরুয়া সন্ত্রাসীদের হামলায় কেড়ে নিয়েছে সব কিছু। বাড়ি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কান্না আর আতঙ্ক সঙ্গী করে এ ভাবেই ক্যাম্পে জীবন কাটছে হাজার হাজার মানুষের।
চার দিন ধরে ধ্বংসলীলা চলেছে উত্তর পূর্ব দিল্লির এই এলাকায়। অনেক বাড়ি আস্ত নেই। ছাই হয়ে গিয়েছে সব কিছু।
এখনও রাস্তার দুই ধারে পোড়া পোড়া বাড়ি। কোনও বাড়ির ছাদ নেই। কোথাও ভেঙে পড়েছে দেওয়াল। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া দোকান ঘরের ভিতর এখনও টাটকা সন্ত্রাস। মাস কেটে গিয়েছে, করোনায় লকডাউন দিল্লি। কিন্তু গণহত্যার ক্ষত মুছে যায়নি। শুনশান রাস্তার ধারে ইতিহাসের দলিল হয়ে জেগে রয়েছে জনমানবহীন কিছু কাঠামো।
উত্তরপূর্ব দিল্লির ভয়াবহ গণহত্যার পরে গৃহহীন, দিশাহীন মানুষদের জন্য বেশ কিছু ক্যাম্পতৈরি করা হয়েছিল। কোনও কোনও ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল ব্যক্তি বা সংস্থার প্রচেষ্টায়। হাজার হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সব অপরিসর আস্তানায়। তাঁদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন, পড়েছেন, দেখেছেন পাঠক। সেই তখনই ক্যাম্পের চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, করোনা ছড়িয়ে পড়লে অপরিসর ক্যাম্পে গায়ে গায়ে বেঁচে থাকা মানুষেরা আরও বিড়ম্বনায় পড়বেন। পড়লেনও। মঙ্গলবার মালাউন সরকারের আদেশে তুলে দেওয়া হয়েছে প্রতিটি ক্যাম্প। ক্যাম্পের অধিবাসীদের বলা হয়েছে ফিরে যেতে নিজেদের বাড়ি। আর যাঁদের বাড়ি নেই, ধ্বংস্তূপে পরণত হয়েছে যাঁদের বাসা, তাঁদের বলা হয়েছে, বাড়ি খুঁজে নিতে।
করোনার কারণে যথেষ্ট আপত্তি সত্ত্বেও উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে শাহিনবাগকে। প্রায় ১০০ দিন ধরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, এনপিআর নিয়ে রাস্তায় বসে পড়েছিলেন সাধারণ ঘরের অসংখ্য নারী। এর আগে রাজনীতি বা আন্দোলনের সঙ্গে যাঁদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। শাহিনবাগ মডেল হয়ে গিয়েছিল গোটা দেশে। রাজ্যে রাজ্যে শাহিনবাগ তৈরি হয়েছিল। করোনার ওজুহাতে আপাতত সেই সমস্ত আন্দোলনও বন্ধ করা হয়েছে। হয়তো লকডাউন শেষ হলে নতুন করে আন্দোলন শুরু হবে। আন্দোলনকারীরা অন্তত সে কথাই বলছেন।
কিন্তু ক্যাম্পের মানুষেরা? অযাচিত বর্বর হিন্দু সন্ত্রাসীদের হামলায় কেড়ে নিয়েছিল যাদের সুখী গৃহকোণ। তাঁরা যেচে ক্যাম্পে আসেননি।
মেডিক্যাল ক্যাম্পে অন্তঃসত্ত্বা
২৮ সপ্তাহের শিশুকে পেটে নিয়ে মাঝ রাতে প্রাণ বাঁচাতে দৌড়েছিলেন মা। ক্যাম্পেই চলছে তাঁদের চিকিৎসা।
মাঝরাতে পেটে চার সপ্তাহের সন্তান নিয়ে যে মহিলা দেখে ছিলেন নিজের বাড়ি ছাই হয়ে যেতে, আক্রমণকারীদের তাড়া খেয়ে যিনি মাইলের পর মাইল দৌড়ে একটা ত্রিপলের আশ্রয় পেয়েছিলেন, কী হবে তাঁর? মাত্র এক সপ্তাহ আগে মুস্তাফাবাদের ক্যাম্পে এক মুখ আতঙ্ক আর ভয় নিয়ে সাংবাদিককে সেই মহিলা বলেছিলেন, ”ওই রাতে পেটের বাচ্চাটা মরে গেলেই ভাল হত বোধহয়। ওর জন্ম হলে কোন পৃথিবী উপহার দেব ওকে? জন্মের মুহূর্তেই তো ও জেনে যাবে ওর কোনও বাড়ি নেই, কোনও আশ্রয় নেই।” বুধবার সেই মহিলাই ফোনের ও প্রান্তে কেবলই নিঃশ্বাস নিয়ে গেলন। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়া আর কোনও অভিব্যক্তি নেই। জানেন না, এর পর এই ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতিতে পেটের বাচ্চাকে কোন আশ্রয়ে পৌঁছে দেবেন। ক্যাম্পে তাও খানিকটা আশ্রয় পেয়েছিলেন এখনও আহত, আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত কয়েক হাজার মানুষ। এ বার তাঁরা কোথায় যাবেন, কী করবেন, কেউ জানে না।
ক্যাম্পের দিকে দিকে এ ভাবেই ছড়িয়ে রয়েছে সব হারানো মুখ।
সরকার নির্দেশ দিয়েছে, যাঁদের বাড়ি এখনও সামান্য অক্ষত, তাঁরা যেন বাড়ি ফিরে যান। আর যাঁদের নেই, তাঁদের ভাড়াবাড়ি খুঁজে নিতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন এবং ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবকরা বাড়ির ব্যবস্থা করছেন। তবে তা যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা। পাঁচ সন্তানকে নিয়ে ক্যাম্পে ছিলেন শাবানা আনসারি। ফিরে যাওয়ার মতো বাড়ি নেই তাঁর। সব জ্বলে গিয়েছে। এক কাপড়ে সন্তানদের নিয়ে ক্যাম্পে চলে এসেছিলেন। বুধবার সকালে তাঁর প্রশ্ন, ”তিন হাজার টাকা আর কিছু চাল-ডাল নিয়ে এতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় বাড়ি খুঁজব? কে দেবে বাড়ি আমায়?” দিল্লিতে এমনিতেই এখন বাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না। করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই বাড়িওয়ালারা ভাড়া দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। লকডাউনের পরে বাড়ি পাওয়া আরও মুশকিল। পুলিশ রাস্তায় হাঁটতে চলতে দিচ্ছে না। পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ। এই অবস্থায় ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত মানুষেরা আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন। অনেকেই বলছেন, ক্যাম্পে থেকে করোনা হলে অন্তত একটা হাসপাতালে পৌঁছনো যেত, অন্তত কিছুদিন মাথা গোঁজার একটা জায়গা পাওয়া যেত। এখন সেটুকুও নেই।
আর যাঁরা ফিরেছেন নিজেদের বাড়ি? দশ বছরের এক শিশু টেলিফোনে সাংবাদিককে বলেছেন, নিজের বাড়িতে ঢুকে দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। কেবলই মনে হচ্ছে হাতে অস্ত্র নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে শেষ করে দেবে কিছু হিংস্র মানুষ। চোখ বুজতে হচ্ছে না, খোলা চোখেই দৃশ্যগুলি ভেসে আসছে বার বার। শিশুর বাবার বক্তব্য, ”বাড়ি তো ফিরে এলাম। কিন্তু সামান্য জিনিস কিনতে পাড়ার দোকানে যেতেও ভয় হচ্ছে। যদি কোনও অঘটন ঘটে যায়। যে আগুনকে পিছনে ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেই আগুনের ভিতরেই আবার ঢুকে পড়লাম মনে হচ্ছে। এ ভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব।”
গোটা দিল্লির মুখে এখন কেবলই করোনা। উচ্চ-মধ্য-নিম্নবিত্ত, গরিব-এলিট সকলেই ২১ দিনের লকডাউনকে স্বাগত জানিয়েছেন। সকলেই বুঝতে পারছেন, করোনা ছড়াতে শুরু করলে কী সাংঘাতিক পরিস্থিতি তৈরি হবে। শুধু উত্তরপূর্ব দিল্লির এক বিশাল অঞ্চল করোনা আতঙ্ক টের পাচ্ছে না। জীবনই তাঁদের কাছে এখন সব চেয়ে বড় আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্যাম্প থেকে উৎখাত হওয়া এই মানুষগুলির জন্য দ্রুত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? অন্তত লকডাউনের ২১ টা দিন যাতে কোনও ভাবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারেন তাঁরা? পরের কথা পরে হবে। আপাতত এটুকু হোক। কিছু মানুষকে এ ভাবে বাঘের খাঁচা থেকে সিংহের গুহায় পাঠিয়ে দিলে মনুষ্যত্ব ক্ষমা করবে না।