করোনাভাইরাসের মহামারী রুখতে ছুটি আর বিধিনিষেধে থমকে গেছে রাজধানীসহ সারাদেশে খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রা।
এক সপ্তাহ আগেও তাদের কেউ প্রতিদিন রিকশা ভ্যান নিয়ে বের হতেন, কেউবা দিন চুক্তির মজুরিতে কাজ করতেন। অনেকে আবার বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে চালাতেন সংসার।
রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি কিংবা টিনশেড ঘরে এইসব খেটে খাওয়া মানুষের বসবাস। দিনের কাজের টাকায় তাদের বাজার হয়, চুলায় হাড়ি চড়ে। তাদের সেই দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনেও ছন্দপতন ঘটিয়েছে করোনাভাইরাস মহামারী।
মালিবাগ রেলগেইট, ঝিলপাড়, কমলাপুর, রামপুরা, বাড্ডা, ফকিরাপুল ও মোহাম্মদপুর ঘুরে নিম্ন আয়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে একই হতাশা আর অনিশ্চয়তার ছবি।
ভোলার চরফ্যাশনের আলী হোসেন ঢাকায় ইট ভাঙার কাজ করেন। গত সাত দিন বস্তির ছোট্ট ঘরে কর্মহীন কেটেছে তার। পেটের তাগিদে সোমবার সকালে পশ্চিম মালিবাগের বাগাানবাড়ি এলাকায় এক নির্মাণাধীন ভবনের পাশে বেড়ার আড়ালে ইট ভাঙতে বসেছেন তিনি।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “কী করব স্যার, কাজ করতে মানা। কিন্তু এভাবে থাকলে তো পেটে ভাত জুটবে না। লুকিয়ে ইট ভাংতেছি। কাজ পাইছি চাইর দিন আগে। কিন্তু খোলা জায়গায় তো কাজ করতে পারতেছি না। এলাকার মুরব্বীরা বারণ করছে। আজকে উনাদের বলে কয়ে কাজ শুরু করেছি, বুঝেন তো।”
রিকশা চালক তমিজউদ্দিন বাড্ডায় থাকেন। ষাট বছর বয়সেও তাকে রিকশা চালাতে হয় বেঁচে থাকার তাগিদে। সোমবার সকাল ৮টায় তাকে মৌচাক মোড়ে বসে থাকতে দেখা গেল যাত্রীর আশায়।
আক্ষেপ করে বললেন, “বুড়াকালে আইসা এঠা কী দেখতেছি বাবা জান। ডাক দিলেও প্যাসেঞ্জার রিকশায় উঠতে চায় না। কম ভাড়ার কথা কইছি, তারপরেও কয় ‘যামু না’।”
রোজগার এভাবে বন্ধ হয়ে গেলে ছেলেমেয়েকে কী খাওয়াবেন , সেই চিন্তায় দিশা পাচ্ছেন না তমিজউদ্দিন।
মৌচাক মোড়ে একটি রিকশার গ্যারেজের ভেতরে বসে ছিলেন আখলাক মিয়া, সঙ্গে তার বানর ‘রূপবান’। বানর নাচিয়েই তার দিন চলে। আর স্ত্রী বিভিন্ন বাসায় গিয়ে করেন গৃহকর্মীর কাজ।
আখলাক জানালেন, গত সাতদিন ধরে তার রোজগারের পথ একেবারেই বন্ধ। তার স্ত্রীকেও কাজে যেতে মানা করেছেন বাড়ির মালিকরা।
“তাইলে চলমু কেমনে বলেন? আমার উপার্জনের শক্তি এই বান্দর, তারে ‘রুপবান’ বইলা ডাকি, তারেও খাবার দিবার পয়সা নাই। শিকল দিয়া বাইন্দা রাখছি ৭ দিন হয়। আমরা আর রূপবান সবতেই বন্দি।”
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণ ঠেকাতে চলাফেরা বন্ধ করে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশে অচল হয়ে পড়েছে বিশ্বের বড় একটি অংশ। মানুষকে বাঁচানোর জন্যই এ সতর্কতা, কিন্তু প্রান্তিক মানুষের জন্য তা নিয়ে এসেছে অনাহারে মৃত্যুর শঙ্কা।
শান্তিনগরের কাছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করেন প্রতিবন্ধী জুলেখা। পোলিওতে তার দুই পা নষ্ট হয়েছে ছোটবেলায়। ভিক্ষা করে এমনিতে প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা যা পাওয়া যেত, তা দিয়েই চলতে হত তাকে। এখন রাস্তায় মানুষ নেই, ভিক্ষার পথও বন্ধ।
“গত কয়দিন বস্তিতেই ছিলাম। ঘরে আর মন টিকে না। আইজ সকালে চাইর ঘণ্টা দাঁড়ায়ে ছিলাম, একজন খালি একটা ৫ টাকার কয়েন দিছে। মানুষের দয়ায় বাঁইচ্যা আছি। কাজ করার মত অবস্থাতো আমার নাই। করোনা আমাগো লাইগা গজব। এইটা না গেলে আমরাতো মারা যামু।”
আকলিমার বয়স ত্রিশের ঘরে, কমলাপুরের কাছে ঠেলাগাড়িতে করে প্লাস্টিক-এলুমিনিয়ামের জিনিসপত্র ফেরি করেন তিনি। বাবা-মাকে নিয়ে তিনিও পড়েছেন বিপদে।
“এখন কেউ এগুলো কিনে না। কাইল শান্তিনগরে দাঁড়াইছিলাম কতক্ষণ। একটা জিনিসও বিক্রি করতে পারি নাই। পুলিশ মাইক দিয়া কইয়া গেছে- কেউ দাঁড়াবার পরব না। আমরা এখন কই যামু, বুঝতাছি না।”
মালিবাগের বাগান বাড়ির কাছে দেখা গেল রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে সারি সারি রিকশা ভ্যান।
মালিক আব্দুস সাত্তার বললেন, “দোকান-পাট, অফিস-আদালত বন্ধ। মাল টানার কাজ নাই। গাড়ি চালানোরও লোক নাই, অনেকে দেশের বাড়ি চলে গেছে।”
বাঁশবাড়ি বস্তির হোসনে আরা, জমিলা, আখতারুন্নেসা জানান, তারা বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। কিন্তু এই ‘অসুখ-বিসুখের’ সময়ে বাড়ির মালিকরা কাজে যেতে মানা করে দিয়েছেন।
আজহার নামের এক রিকশা চালক বললেন, সকাল থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত রাস্তায় থেকে তিনি কেবল ২০ টাকার ‘খ্যাপ’ পেয়েছেন।
করোনা ভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জ উপজেলার জনজীবন।
আদমপুর বাজারে ঘোরামারা পয়েন্টে সমানে অপেক্ষা করছিলেন এক অটোরিক্সা চালক। করোনা ভাইরাসের পরিস্থিতিতে কেমন চলছে জীবন যাত্রা? জিজ্ঞেস করতেই মণিপুরি মুসলিম সম্প্রদায়ের হাফিজ উদ্দিন অটো রিকসাচালক বলেন ওইসব কথা।
করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে দেশব্যাপী। সারাদেশে সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের জনসমাগম নিষেধ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ও কোচিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমন রোধে সচেতনতার জন্য মাস্ক ও জীবানুমুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। জরুরী কোন কাজ ছাড়া আগামী ১৪দিন রাস্তাঘাটে মানুষকে না বেরোনোর জন্য বিশেষ ভাবে সর্তক করা হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন স্থানে মাইকিং করে প্রচার করা হচ্ছে রাস্তায় বের না হওয়ার জন্য।
গত কয়েকদিন থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার রাস্তাঘাটে যানবাহন, অটোরিক্সা, রিক্সা, ভ্যান ও মোটাসাইকেল চলাচল অনেকটা কমে গেছে। শহরে রাস্তাঘাটে অটোরিক্সা ও ভ্যান তেমন চোখে পড়ছেনা। আতঙ্কে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষরা বিপাকে পড়েছেন। আয় রোজগারের কোন পথ না থাকায় পেটের দায়ে তারা ঘরে থাকতেও পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন।
এদিকে মুন্সিবাজার ইউনিয়নের সরিষকান্দি শব্দকর পাড়ার ২৫-৩০টি পরিবার করোনা প্রভাবে ভাল নেই। করোনা ভাইরাসে করনীয় বিষয়ে কিছুই জানেনা না তারা। ঘন বসতি নোংরা পরিবেশে রোগ জীবাণু নিয়ে বসবাস করছে শব্দকর সমাজ। ভ্যান-ঠেলা- রিকশা চালিয়ে ও ভিক্ষাবৃত্তি করে চলা জীবন করোনা প্রভাবে স্তমিত হয়ে গেছে। অনাহারে দিন কাটছে তাদের। ছোট ছোট বাচ্চারা বলছে বাবা রিকশায় যায়নাই তাই লাল চা আর চাল ভাজা খেয়ে দিন পার করছি।
করোনা আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। তাই আতঙ্কিত না হয়ে দুই সপ্তাহ ঘরে সময় কাটানোর জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বার বার সচেতন করা হচ্ছে।করোনা ভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে মৌলভীবাজারে কমলগঞ্জ উপজেলা জনজীবন।
নিত্যদিন সকালবেলা গরীব কৃষকেরা শাক-তরকারী বেচতে বাজারের দিকে যেতেন। ওতে তাঁদের যা কিছু পকেটস্থ হতো তা দিয়ে পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন মেটাতেন। হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনিতে রিকসা চালিয়ে দু’পয়সা রোজগার করতেন রিকসাওয়ালারা। এভাবে মাছবিক্রেতা, সবজিবিক্রেতা—এঁদের প্রত্যেকেই হররোজ রোজগারের উপরে নির্ভরশীল। হুকুমতের বাসিন্দারা কি কালেভদ্রেও সে-সব প্রান্তিক মানুষের খবর রেখেছেন?