করোনা শুরু হতেই নড়াইলের বিভিন্ন এলাকায় গরিবের চাল চুরির হিড়িক চলেছে। এরই মধ্যে চেয়ারম্যানসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি ধরা খেয়েছেন আবার কেউ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
সম্প্রতি ৪১ টন ভিজিডির চাল চুরির দায়ে দুদকের মামলায় জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে পিরোলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যাকে। এলাকার ৮৫ জন দুস্থ নারীর ১৬ মাসের চাল আত্মসাৎ করেও তিনি ক্ষান্ত হননি। চাল না পাওয়া দরিদ্র নারীদের জোর করে মাস্টাররোলে টিপসই দিতে বাধ্য করেছেন। গরিব মানুষের মুখ বন্ধ করতে সন্ত্রাসী বাহিনী ঢুকিয়ে গুচ্ছগ্রামে গুলিবর্ষণের মতো ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
ধরা খাবার পরেও থেমে নেই এসব কর্মকাণ্ড। চেয়ারম্যানের চুরি ঢাকতে মাঠে নেমেছে পোষ্য সন্ত্রাসী বাহিনী। এরা প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে ঢুকে চাল না পাওয়া অসহায়-দুস্থ নারীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে মাস্টাররোলে টিপসই আদায় করে নিচ্ছেন। ভয়ে কেউ স্বাক্ষর করে দিচ্ছেন আবার অনেকে টিপসই দেওয়ার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতায় পিরোলী ইউনিয়নের ১৯০ জন ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ নারীকে বিনামূল্যে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা। প্রতিমাসে চাল উত্তোলন করলেও ৮৫টি ভিজিডি কার্ডধারী নারীকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত চাল দেওয়া হয়নি। ৮৫ জনের বিপরীতে ১৬ মাসে (মাসিক ২৫৫০ কেজি) ৪০ টন ৮০০ কেজি সরকারি চাল দুর্নীতি বা বেআইনিপন্থায় আত্মসাৎ করেছেন চেয়ারম্যান জারজিদ।
জুয়া খেলার ছবি তোলায় সাংবাদিক পেটানো, একাধিক হত্যা, জুয়া ও মাদক, বসতবাড়ি উচ্ছেদ, ভূমি অফিসের নায়েবকে পেটানোসহ ডজনখানেক মামলা রয়েছে এই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। আলোচিত এই সন্ত্রাসী ইয়াবাসেবী চেয়ারম্যান আটক হওয়ার পরও স্বস্তিতে নেই এলাকার নিরীহ লোকজন। নানা ছলে আর ভয়ভীতি দেখিয়ে দুস্থ নারীদের চাল না দিয়ে উল্টো তাদের কাছ থেকে ১৬ মাসের মাস্টাররোলে টিপসই নেওয়া হচ্ছে।
ধরা খাবার আগে ২৬ এপ্রিল জামরিলডাঙ্গা গ্রামের পাঁচজন নারীকে ইউনিয়ন পরিষদে চাল দেওয়ার কথা বলে ডেকে আনা হয়। এরপর দোতলার একটি কক্ষে আটকে রেখে চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে প্রত্যেককে ১৬টি করে মাস্টাররোলে টিপসই নিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কাঁদতে কাঁদতে খালিহাতে ফিরে আসেন অসহায় তারা। ভয়ে টিপসই দেওয়া পেড়লী গ্রামের পাঁচজনের মধ্যে ১৫১ তালিকার হুরী বেগম, ১৪৯ তালিকার নুর নাহার ও ১৫৩ তালিকার ছায়েরা বিবির দিন এখন আরো কষ্টে কাটছে। (কালের কন্ঠের রিপোর্ট)
বাড়িতে এসে টিপসই দেবার কথা স্বীকার করায় হুমকির মধ্যে পড়েছেন তারা। বাকিরা ভয়ে অন্যকে কিছু জানাতে পারছেন না। চেয়াম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনী ২৭ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত খড়রিয়া গ্রামের চাল না পাওয়া অন্তত আট নারীর কাছ থেকে জোর করে টিপসই নিয়েছে। ভয়ে কোনো কথা বলেনি হতদরিদ্র ও নারীরা।
৮ মে রাতে পেড়লী গ্রামের মরজিনা বেগমের বাড়িতে আসে চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসী বাহিনী। চেয়ারম্যান জারজিদ এর স্ত্রী মুর্শিদার সাথে শহীদুল ভূইয়া, বাবলু ভূইয়া, শিহাব ভূইয়ার নেতৃতে ৮/১০ জনের একটি দল বাড়িতে ঢুকে দেশীয় অস্ত্র প্রদর্শন করে মরজিনার ১৬টি টিপসই নেয় মাস্টাররালে। এই ঘটনায় জানাজানি হলে গ্রামে হইচই পড়ে যায়। ইউপি মেম্বার লেন্টু, ফুরকান ও মুক্তি মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
এদিকে কার্ড থাকলেও ১৬ মাস চাল পান না পেড়লী গ্রামের আরো অন্তত ১০ জন। এদের মধ্যে ১৬০ ক্রমিকের পিয়ারী বেগম, ১৬১ হেনা বেগম, ১৬২ নার্গিস বেগম, ১৬৩ সিমকী খাতুন, ১৬৭ রোজিনা বেগম, ১৭২ রেবেকা বেগম। চেয়ারম্যানের সন্ত্রাসীদের ভয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এসব নারী।
টিপসই দেওয়ার ভয়ে পলাতক একজন জানান, এমনিতে আমাদের চাল মেরে খেয়েছে চেয়ারম্যান তার ওপর তার বাহিনী দিয়ে জোর করে মাস্টাররোলে স্বাক্ষর করায়ে নিচ্ছে, করোনার চেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে গুণ্ডাদের? এই দেশে কি কোনো আইন-কানুন নাই?
পিরোলী ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার গোলাম রব্বানী, ৭ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মো. লেন্টু শেখ বলেন, চেয়ারম্যান নিজে আমাদের গ্রামের ভিজিডি কার্ডের নাম কেটে নিজের গ্রামে দিয়েছে। অল্প কয়েকজন গরিব মহিলা চাল পেত তাদের মাল না দিয়ে উল্টো বাহিনী দিয়ে স্বাক্ষর করায়ে নিচ্ছে, এটা চরম অন্যায়। ৮ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বর মো. ফুরকান শেখ বলেন, এলাকার কয়েকজন ভিক্ষুক মহিলাকে ভিজিডি কার্ড করে দেওয়া হয়েছিল, তাদের চাল মেরে দিয়ে চেয়ারম্যান চরম অন্যায় কাজ করেছেন। এখন আবার সন্ত্রাসীরা জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাচ্ছে।
সন্ত্রাসী বাহিনীর নেতৃত্বদানকারী চেয়ারম্যান জারজিদ মোল্যার স্ত্রী মুর্শিদা খানমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, আমরা তো জোর করে কারো স্বাক্ষর আনিনি। আপনাকে এই অভিযোগ কে দিয়েছে?
আপনারা কি ১৬ মাসের চাল দিয়ে স্বাক্ষর এনেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাল তো চেয়ারম্যান দিয়েই গেছেন।