প্রতিবছর বর্ষা এলেই রাজধানীর রাস্তাঘাট, অলিগলি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। নগরবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ নিয়ে অসন্তোষের শেষ নেই রাজধানীবাসীর। তবে কোনো কিছুকে গুরুত্ব না দিয়েই বছরের পর বছর ওয়াসা তাদের মতো চলছে। বর্ষা পেরোলে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। মুখে ফোটে কথার ফুলঝুরি। কর্তৃপক্ষের দাবি, প্রতিবছরই রাজধানীর স্যুয়ারেজ সিস্টেম, ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়ন হচ্ছে। এমনকি খাল উদ্ধারে কাজ চলছে। আগামী বর্ষায় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ১০ বছরে কোনো উন্নতি নেই। বর্ষা এলে আবার সেই ভোগান্তি আর জলজট।
প্রায় এক দশক ধরে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। তার দায়িত্বকালীন প্রতিবারই বর্ষায় রাজধানীর রাস্তাঘাট বৃষ্টি হলেই ডুবছে আবার ভাসছে। ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আগামীবার আর এ অবস্থা থাকবে না। অর্থাৎ আগামীবার আর শেষ হচ্ছে না। রাজধানীজুড়ে দখল হয়ে যাওয়া ওয়াসার খাল পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন সময়ে উদ্যোগ নিয়েছে ওয়াসা। তবে কাজের কাজ হয়নি। খাল উদ্ধারের সুফল মেলেনি। অথবা উদ্ধার হওয়া খাল পুনরায় দখল হয়ে গেছে।
ভারী বৃষ্টি হলে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা যখন ভয়াবহ আকার নেয় তখন সরকারি দুটি সংস্থা পরস্পরের ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
খাল উদ্ধারে ব্যর্থতার গ্লানি থেকে বাঁচতে প্রায় এক যুগ ধরে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেছেন, জলাবদ্ধতার দায়ভার ঢাকা ওয়াসার একার না। ২০১২ সালে বলেছিলাম ঢাকা ওয়াসার কর্মকান্ডের সঙ্গে এটা সম্পর্কিত না। ওয়াটার অ্যান্ড স্যুয়ারেজের সঙ্গে পানি নিষ্কাশন সম্পৃক্ত হওয়ায় খাল পরিষ্কারের দায়িত্ব এক হাতে হওয়া দরকার এবং অবশ্যই সিটি অথরিটির কাছে যাওয়া উচিত। ২০১২ সাল থেকে এটা নিয়ে অনেক কাজ হয়ে আসছে, অনেক কমিটিও কাজ করছে। মেয়রদের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, অত্যন্ত ভালো, আমরা খুশি। ২০২০ সালে এসে ২০১২ সালের সিদ্ধান্তটাকে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি। তিনি বলেছেন, এই কাজ ওয়াসার না, এটা মূলত সিটি করপোরেশনের। সহযোগিতা সবাই করবে, ওয়াসাও করবে। কাজেই এটা সিটি করপোরেশনের কাছে চলে যাওয়াটাই ভালো, এক সময় তাই ছিল।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল এক সময় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাতে। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ওয়াসার হাতে ন্যস্ত করে। তবে সেটা পুরোপুরি ওয়াসার একার হাতে আসেনি। অন্য ৭টি সংস্থাকে পানি নিষ্কাশন কাজে জড়িয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে এ বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইমেরিটাস অধ্যাপক প্রকৌশলী ড. এম ফিরোজ আহমেদ বলেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কোনো আলাদা ফান্ড নেই। যে জন্য কোনো সংস্থা দায় নিতে চায় না। প্রথমে ছিল এটা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের হাতে, যা পরে ওয়াসার হাতে চলে যায়। ওয়াসার অন্য খাত থেকে টাকা এনে এখানে ব্যয় করতে হয়। যেহেতু এখানে কোনো রাজস্ব পায় না, তাই ওয়াসা কাজ করতে আগ্রহী নয়। এখন সিটি করপোরেশনের কাছে গেলে তারা নিশ্চয় হোল্ডিং ট্যাক্স থেকে আয় বের করে কাজ করতে পারবে।
ঢাকা ওয়াসা ও সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় ৪৩টি খাল ছিল। এসব খালের মধ্যে ২৬টি ঢাকা ওয়াসা ও ৮টি ঢাকা জেলা প্রশাসন রক্ষণাবেক্ষণ করছে। আর ৯টি খাল বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে। বাকিগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এসব খালে নেই পানি প্রবাহ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে সিটি করপোরেশনের এই প্রতিবেদনের খালের হিসাবের সঙ্গে একমত নন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা জানিয়েছেন খালের সংখ্যা ছিল ৫২টি। বাকি খালগুলোর এখন অস্তিত্ব নেই।
সিটি করপোরেশন ও ওয়াসার করা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, বিদ্যমান খালগুলোর মধ্যে রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬০, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩০, প্যারিস খাল ২০ ফুটের জায়গায় ১০-১২, বাইশটেকি খাল ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮-২০, বাউনিয়া খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ৩৫-৪০, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের জায়গায় ১৭০, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের জায়গায় ৬৫, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের জায়গায় স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০, কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশাল অংশে এখন সরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের জায়গায় ২৫ থেকে ৩০, কাঁটাসুর খাল ২০ মিটারের জায়গায় ১৪ মিটার, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেত সংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের জায়গায় ১৮ ফুট রয়েছে। অর্থাৎ পানি প্রবাহের সব খাল এখন অর্ধেকের বেশি কোথাও কোথাও প্রায় পুরোটাই দখলে চলে গেছে। এসব খালের অধিকাংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন, দোকানপাট ও ময়লা-অবর্জনা ভরাট করে রেখেছে। ফলে খালে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দখল-দূষণের পরেও যে পরিমাণ খাল রয়েছে সেটাও যদি সচল রাখা যেত তাহলে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।
এদিকে এসব খাল ও ড্রেন সচল করার জন্য প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় ধরা হচ্ছে। ওয়াসা এ পর্যন্ত শত কোটি টাকা খরচ করেছে। এ ছাড়া এ বছর সড়ক, ফুটপাত ও সারফেস ড্রেন নির্মাণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ব্যয় করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয় ৭১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। একইভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এই খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭২ টাকা। কিন্তু ব্যয় হয়েছে ১৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। আমাদের সময়