গরিব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘর তৈরি এবং ঘরের ছাউনির একমাত্র ভরসা দেশে উৎপাদিত কমমূল্যের ঢেউটিন। পণ্যটির মূল কাঁচামাল আমদানিকৃত এইচআর কয়েল (হট রোলড কয়েল)। করোনা ভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমেছে। কিন্তু তা না মেনে এবং বিধি লঙ্ঘন করে বর্ধিত মূল্যে শুল্কায়ন করছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ।
এতে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন দেশের স্টিল মিল ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে অতিরিক্ত শুল্কায়ন মূল্যের কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে বর্তমান জাতীয় সংকটে অর্থকষ্টে থাকা মানুষের বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।
দেশীয় শিল্পের উন্নয়ন এবং বাজারে কম মূল্যে পণ্য সরবরাহের চেইন ঠিক রাখতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা উচিত। বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুসরণ করে শুল্কায়ন করাই ন্যায়সঙ্গত। ব্যবসায়ী নেতাদের অভিযোগ, কম মূল্যে আমদানি করা পণ্য বেশি মূল্যে শুল্কায়ন না করতে চট্টগ্রাম চেম্বারসহ ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে চিঠি দেওয়া হলেও তা আমলে নিচ্ছেন না চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনার।
জানা গেছে, দেশের প্রচলিত শুল্কমূল্য বিধিমালা ২০০০ (এসআরও নং-৫৭/আইন/২০০০/১৮২১/শুল্ক তাং: ২৩/০২/২০০০ইং)-এর বিধি ৫(৪) অনুসারে ‘একই বিধির অধীন অভিন্ন পণ্যের একাধিক বিনিময় মূল্য পাওয়া গেলে উৎসের মধ্যে সবচেয়ে কম বিনিময় মূল্যের ভিত্তিতে আমদানি করা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উচ্চ ‘শুল্কায়িত মূল্য’ অনুসরণ করে বর্ধিত মূল্যে শুল্কায়ন করছে, যা দেশের প্রচলিত শুল্ক আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’
জানা গেছে, ২ মিলিমিটার পুরুত্বের এইচআর কয়েল বর্তমানে গড়ে ৩৯০ ডলার মূল্যে আমদানি হলেও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৪৩০ থেকে ৪৮০ ডলার ধরে শুল্কায়ন করছে। ১ দশমিক ৮ মিলিমিটারের কয়েল ৪০১ ডলারে আমদানি হলেও ৫০০ এবং ১ দশমিক ৬ মিলিমিটারের ৪০৭ ডলারে ক্রয় করলেও ৫৩০ ডলারে শুল্কায়ন করছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। শুল্কায়ন মূল্য বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব পরিশোধ করতে হচ্ছে অনেক বেশি।
এদিকে অতিরিক্ত মূল্যে শুল্কায়নের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এইচআর কয়েলের আমাদানি কমেছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) এইচআর কয়েল আমদানি হয়েছে ৩৫ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার ১৩৩ কেজি, যা গত বছরের (২০২৯) একই সময়ের তুলনায় ২ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ৭০ কেজি কম। অধিক মূল্যে শুল্কায়ন অব্যাহত থাকলে আগামীতে পণ্যটির আমদানি আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। ২০১৯ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) আমদানি হয়েছিল ৭৬ কোটি ৪৩ লাখ ১২ হাজার ৫২৪ কেজি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ানের রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কমমূল্য প্রদর্শন কিংবা আন্ডার ইনভয়েসের কোনো সুযোগ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে স্টিল পণ্যের মূল্য সব সময়ই ওঠানামা করে। ওয়ার্ল্ড স্টিল বুলেটিনে তা নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে এ পণ্যের মূল্য নিম্নমুখী হওয়ার পরও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ কীসের ভিত্তিতে বর্ধিত মূল্যে শুল্কায়ন করছে তা তাদের বোধগম্য নয়। অবশ্য কাস্টম কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারি রাজস্ব আদায় বাড়াতে বেশি দামে শুল্কায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে রাজস্ব বাড়াতে বেশি দামে শুল্কায়নের কথা কোন বিধি বা আইনে উল্লেখ নেই।
জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও তাইওয়ান থেকে দেশের উদ্যোক্তারা এইচআর কয়েল আমদানি করেন। ঢেউটিন উৎপাদন করে বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে আবুল খায়ের গ্রুপ (গরু মার্কা), পিএইচপি গ্রুপ (অ্যারাবিয়ান হর্স), টিকে গ্রুপ (ঈগল মার্কা), কেডিএস গ্রুপ (কেওয়াই মুরগি মার্কা), এস আলম গ্রুপ (মোরগ মার্কা) ও অ্যাপোলো ইস্পাত (অ্যাপোলো রাণী মার্কা)। সূত্র জানায়, উচ্চমূল্যে শুল্কায়নের কারণে অ্যাপোলো ইস্পাতের উৎপাদন প্রায় বন্ধের পথে।
আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম কমেছে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, বর্তমান আমদানি মূল্য না মেনে বেশি দামে শুল্কায়ন করছে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ। ক্ষেত্রবিশেষ দ্বিগুণ দামে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম চেম্বার থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে বর্তমান বাজার মূল্য হিসেবে অ্যাসেসমেন্ট করতে বলা হয়েছে। কারণ এভাবে অ্যাসেসমেন্ট করলে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু কমিশনার এখনো ইচ্ছেমতো দামে শুল্কায়ন করছে।
এদিকে ফ্ল্যাট স্টিল কাঁচামালের আমদানি মূল্য নির্ধারণকে অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত উল্লেখ করে উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মহামারী নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য কমে যাওয়ায় স্টিলজাত পণ্যের মূল্য কয়েক মাস ধরে নিম্নমুখী। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এটির ওপর টন প্রতি ৫০ থেকে ১৫০ ডলার বাড়িয়ে অতিরিক্ত শুল্ককরাদি আদায় করছে। এইচআর কয়েল শুল্কায়নে প্রতিনিয়ত বর্ধিত মূল্যে শুল্কায়ন নিতান্তই অবিবেচনাপ্রসূত।
আমদানি পণ্যের শুল্কমূল্য নির্ধারণ যৌক্তিক জায়গা থেকে নিশ্চিত করা না হলে ফ্ল্যাট স্টিল তৈরি করছে এমন কারখানাগুলো বন্ধের উপক্রম হবে। এ ক্ষেত্রে একদিকে পর্যাপ্ত জোগানের অভাবে বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশীয় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনামূলক কর্মসূচিও চরমভাবে ব্যাহত হবে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার মো. ফখরুল আলম আমাদের সময়কে বলেন, সরকারের রাজস্ব আদায়ের দিকে দেখতে হবে। তাই অ্যাসেসমেন্ট কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুল্কায়ন হচ্ছে।