আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দাঙ্গা এখন বিস্তৃতি লাভ করছে। এখন এটি পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক সংঘাতে, যা অচিরেই গৃহযুদ্ধের দিকেও মোড় নিতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক, এমনকি সাংবাদিকরাও।
আমেরিকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়েছে। এদের একদল মনে করে, পুরো আমেরিকান ব্যবস্থা, সমাজ এবং ইতিহাসই বর্ণবাদী। তাই তারা পুরো রাষ্ট্রীয় কাঠামোকেই শত্রু মনে করে। এই দলের মধ্যে আছে অ্যান্টিফা (ANTIFA – Anti Fascist) নামে একটি উগ্র বামপন্থী দল। এরাই সবচেয়ে বেশি লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুর করছে। তারা আদর্শিকভাবে চালিত। তারা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের সমর্থক। LGBT অধিকার থেকে শুরু করে সব উগ্র সেক্যুলার অবস্থান তারা সমর্থন করে। নিজ উদ্দেশ্য অর্জনে যেকোনো পদ্ধতি ব্যবহারে তারা প্রস্তুত। তারা বিপ্লব চায়।
অন্যদিকে চলমান সহিংসতার বিপরীত মেরুতে আছে ট্রাম্পের সমর্থকগোষ্ঠী। যেখানে সাধারণ রিপাবলিকানদের পাশাপাশি আছে উগ্র ডানপন্থী-শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী, টি-পার্টি এবং আমেরিকান মিলিশিয়াগুলো। তারা নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। অ্যান্টিফা এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে তারা ‘আমেরিকান সংস্কৃতি ও ইতিহাস’ এর জন্য হুমকি মনে করে। আর অ্যান্টিফার সাথে সংঘাতকে আমেরিকার পরিচয়ের লড়াই মনে করে। [১]
কাজেই আমেরিকায় চলমান দাঙ্গার দুই দিক হলো-
ক) উগ্র বামপন্থী আমেরিকা: যারা বিদ্যমান আমেরিকান রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে শত্রু মনে করে।
খ) উগ্র ডানপন্থী আমেরিকা: যারা বিদ্যমান আমেরিকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতিরক্ষায় কাজ করে।
তাদের এই সংঘাত ধীরে ধীরে খুনোখুনির দিকে যাচ্ছে। গত ২৫শে আগস্ট কেনোশা, উইসকনসনে একজন সশস্ত্র ট্রাম্প সমর্থক ২ জন ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছে।[২] এর প্রতিক্রিয়ায় উগ্র বামপন্থী দল অ্যান্টিফার কর্মীরা বলে, ‘আমাদের একজনকে হত্যা করলে আমরাও তোমাদের একজনকে হত্যা করবো।’[৩]
এরপর গত ২৯শে আগস্ট পোর্টল্যান্ডে একজন সশস্ত্র ব্ল্যাক লাইভস আন্দোলনকর্মী ১ জন ট্রাম্প সমর্থককে গুলি করে হত্যা করেছে। [৪] এ হত্যার পর অ্যান্টিফার কর্মীরা আনন্দ প্রকাশ করেছে। [৫]
এভাবে সহিংসতা বাড়লেও আমেরিকার সরকার এ দাঙ্গা ও বিশৃংখলা দমনে ব্যর্থ। ট্রাম্পের কেন্দ্রীয় সরকার শক্রি প্রয়োগে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার ও অ্যান্টিফাকে দমন করতে চায়। অন্যদিকে যেসব রাজ্যে ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় সেখানে তারা ট্রাম্পের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে। [৬] এছাড়া তারা দাঙ্গাকারীদের প্রতি নমনীয় এবং তাদেরকে তেমন কোনো বাঁধা দিচ্ছে না। ফলে এটাকে নিছক ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারী বনাম ট্রাম্প সমর্থকদের দ্বন্দ্ব বলা অতি সরলীকরণ। দুঃখজনকভাবে দেশী-বিদেশী মিডিয়া এই সরলীকৃত রূপটাই তুলে ধরছে।
আজকের এই সংঘাত বরং আমেরিকার রাজনীতির গভীর ফাটলের প্রতিফলন। এই ফাটল দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হচ্ছিল। কোভিড-১৯, জর্জ ফ্লয়েডের আন্দোলন এবং ২০২০ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে এটা একেবারে সামনে চলে এসেছে। এখনো আমেরিকার পুরো সমাজ এ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েনি। বড় এক অংশ এখনো দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ২০২০ এর নির্বাচন, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি মিলিয়ে সামনে এই সংঘাত সমাজের অন্যান্য স্তরেও ছড়িয়ে পড়ে আরো তীব্র আকার ধারণ করার সম্ভাবনা আছে।
অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, ২০২০ এ যেই জিতুক, ২০২৪ পর্যন্ত এই সংঘাত ক্রমেই আরো তীব্র হতে থাকবে এবং ২০২৪ এর নির্বাচনকে ঘিরে এই সংঘাত আরো বিস্ফোরক হয়ে উঠবে। ২০২০ এ ট্রাম্প জিতলে, উগ্র বামপন্থী তথা অ্যান্টিফা আরো রেডিক্যালাইজড হবে (উগ্র হয়ে উঠবে)। আর বাইডেন জিতলে উগ্র ডানপন্থী/মিলিশিয়া/টি-পার্টিগুলো আরো রেডিক্যালাইজড হবে। আর একপক্ষের রেডিক্যাল হওয়া অন্য পক্ষকেও রেডিক্যাল করে তুলবে। এভাবে সহিংসতা এবং দুই দিকের রেডিক্যালাইজেশন চলতে থাকলে সেটা কয়েক বছর পর গৃহযুদ্ধের আশঙ্কাও তৈরি করতে পারে।
আমেরিকার এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত মুসলিমদের জন্য সুসংবাদ। কেননা, শত্রুদের মাঝে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বাধানো যুদ্ধজয়ের এক কার্যকরী পদক্ষেপ। তাই মুসলিমদের শত্রু আমেরিকার রাজনৈতিক সংহতি নষ্ট করে দেয়া ছিল মুজাহিদিনের ঘোষিত একটি উদ্দেশ্য। আজ সেই উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন সম্পূর্ণতার দিকে যাচ্ছে বলা, খুব একটা ভুল হবে না।
রেফারেন্স:
[১] https://thehill.com/opinion/national-security/473457-antifa-is-anti-america-and-its-values
[২] https://heavy.com/news/2020/08/kyle-rittenhouse-charged-homicide/
[৪] https://www.nytimes.com/2020/08/30/us/portland-shooting-protests.html
[৫] https://twitter.com/MrAndyNgo/status/1299951299417370624
[৬] https://www.foxnews.com/politics/portland-mayor-wheeler-sends-open-letter-to-trump-no-thanks
আলহামদুলিল্লাহ