চারটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) থেকে প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার এবং তার সহযোগীরা ১০ হাজার কোটিরও বেশি টাকা মেরে দিয়েছেন।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী তার আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি বা সাড়ে তিন হাজার কোটি। কিন্তু, তার সত্যিকারের আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, এখন পর্যন্ত তারা জানতে পেরেছেন যে পিকে হালদার অন্তত ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এই অর্থ দিয়ে রাজধানীর মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারের মতো অন্তত সাতটি স্থাপনা তৈরি করা যেত। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ‘হলমার্ক কেলেংকারির পর এটাই দেশের আর্থিক খাতের সবচে বড় আত্মসাতের ঘটনা। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, এখনো যদি সাবধানতা অবলম্বন করা না হয় তাহলে এমন হালদারদের অর্থ আত্মসাৎ ক্রমশ যাবে।’
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, পিকে হালদার ও তার সহযোগীদের মালিকানাধীন ৩০টি প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে এনবিএফআইয়ের কাছ থেকে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে এবং এই অর্থ কানাডা, সিঙ্গাপুর ও ভারতে পাচার করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রও এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
তারা জানায়, বর্তমানে কানাডায় অবস্থানকারী পিকে হালদার ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের (আইএলএফএসএল) থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা, ফাস ফাইন্যান্স থেকে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকা, পিপলস লিজিং থেকে তিন হাজার কোটি টাকা এবং রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অবৈধ ক্যাসিনো মালিকদের সম্পদের তদন্ত শুরু করলে পিকে হালদারের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে আসে।
চলতি বছর ৮ জানুয়ারি দুদক অজ্ঞাত সূত্র থেকে প্রায় ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ টাকার সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করে।
দুদক এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
পিকে হালদারের মালিকানাধীন পি অ্যান্ড এল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের একটি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তদন্তকারীরা দাবি করেছেন যে এই অ্যাকাউন্টে ৭০৮ কোটি টাকারও বেশি সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে।
ভবিষ্যতে কোনো তদন্তে যেন তাদের ফেঁসে যেতে না হয় সেজন্য এই অ্যাকাউন্ট থেকে একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং অ্যাকাউন্টে অর্থ সরিয়ে নেওয়া হত।
পিকে হালদার ২০০৮ সালে আইআইডিএফসির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন।
২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি আইএলএফএসএল-এর এক বোর্ড সভায় এমটিবি মেরিন লিমিটেডের নামে ৬০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদিত হয়। দুদক সূত্র জানিয়েছে, এই ঋণের অর্থ এমটিবির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছায়নি।
এই টাকা বিভিন্ন সংস্থা এবং বিভিন্ন ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল।
এই টাকার মধ্যে পদ্মা ওয়েভিং লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে গেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি, প্যারামাউন্ট অ্যাগ্রোতে ১৪ কোটি, ওকায়মা লিমিটেডে তিন কোটি, তাসমিহা বুক বাইন্ডিংয়ে এক কোটি আট লাখ, জে কে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালে ১১ কোটি এবং চারটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে গেছে চার কোটি।
আইএলএফএসএল-এর পরিচালক ছিলেন স্বপন কুমার মিস্ত্রি এবং তার স্ত্রী ছিলেন এমটিবি মেরিনের চেয়ারম্যান। পিকে হালদারের মালিকানাধীন এইচএএল ইন্টারন্যাশনালের পরিচালকও ছিলেন স্বপন।
স্বপনের ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রি কোলাসিন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। রাজধানীর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে অবস্থিত কোলাসিনের চেয়ারম্যান ছিলেন উত্তমের স্ত্রী অতসী মৃধা।
২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট কোলাসিনের জন্য মূলধন হিসেবে ৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকার ঋণ আবেদন করেন তারা। একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ঋণ অনুমোদিত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এটা ছিল একটা কাগুজে কোম্পানি। কোলাসিনের নামে ঋণ নিয়ে তা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়েছিল।’
এই ঋণের অর্থের মধ্যে ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর ন্যাচার এন্টারপ্রাইজে গেছে প্রায় ২৫ কোটি ৯৭ লাখ। পরে এই টাকা চলে যায় রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে।
দুদক সূত্র জানায়, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ আইএলএফএসএল-এর অন্যতম শেয়ারহোল্ডার এবং এর দুজন পরিচালক এনবিএফআইয়ের বোর্ড সদস্য ছিলেন।
রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের ঋণ পরিশোধের জন্যই ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ এই অর্থ পরিশোধ করে।
বাকী টাকার মধ্যে ইবিএল সিকিউরিটিজ লিমিটেডে প্রায় ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং সিকিউরিটিজ এবং ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ক্যাপিটালে ছয় কোটি টাকা, প্যারামাউন্ট স্পিনিং লিমিটেড এবং প্যারামাউন্ট হোল্ডিং লিমিটেডে ছয় কোটি ২৫ লাখ টাকা, জেকে ট্রেডারে চার কোটি টাকা এবং দুটি ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে প্রায় চার কোটি ৯০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক এশিয়ার ধানমন্ডি শাখায় এইচএএল ইন্টারন্যাশনালের অ্যাকাউন্টে প্রায় ৫০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়।
আইএলএফএসএল শঙ্খ বেপারীর মালিকানাধীন মুন এন্টারপ্রাইজের নামে প্রায় ৮৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকার ঋণ মঞ্জুর করে।
এই অর্থে ২১ কোটি ২৪ লাখ টাকা রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে মার্কো ট্রেডার্সের ঋণ পরিশোধে ব্যবহৃত হয়। আইএলএফএসএল-এর পরিচালক নওশের-উল ইসলাম মার্কো ট্রেডার্সের মালিক।
২০১৬ সালের ২৯ মার্চ প্রায় তিন কোটি টাকা পিকে হালদারের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়।
এইচএএল ইন্টারন্যাশনাল পায় ছয় কোটি টাকা এবং ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা প্যারামাউন্ট স্পিনিং লিমিটেডের মার্কেন্টাইল, মেঘনা ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেডের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়।
সূত্র জানায়, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে পিকে হালদার চাচাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ছিলেন পিপলস লিজিং এবং ফিনান্সিয়াল সার্ভিসেসের পরিচালক এবং সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছিলেন চেয়ারম্যান।
অমিতাভ অনান কেমিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও চেয়ারম্যান উজ্জ্বল কুমার নন্দী এবং তার স্ত্রী অনিতা কর পরিচালক। যদিও তারা এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে থাকলেও পিকে হালদার এর প্রকৃত মালিক বলে জানান দুদক কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্র জানিয়েছে যে ‘নাম সর্বস্ব’ প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে পিকে হালদার আইএলএফএসএল থেকে অর্থ নিন এবং পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হন। পরবর্তীতে তিনি পিপলস লিজিংয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা আত্মসাৎ করেন।
চলতি মাসের শুরুতে পিকে হালদার বলেছিলেন যে তিনি ‘তার জীবনের যথাযথ নিরাপত্তা’ পেলে এই অর্থ ফেরত দিতে এবং কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন ও দায়বদ্ধতা নিষ্পত্তির জন্য দেশে ফিরে আসবেন।
তিনি সম্প্রতি এই লক্ষ্যে আইএলএফএসএলকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন।
আইএলএফএসএল-এর পরিচালনা পর্ষদ তাদের বৈঠকে চিঠিটি নিয়ে আলোচনা করেছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রয়োজনীয় আদেশের জন্য গত ৭ সেপ্টেম্বর আইনজীবী মাহফুজুর রহমান মিলনের মাধ্যমে উচ্চ আদালতে একটি আবেদন জমা দিয়েছে।
চিঠি এবং আবেদন পরীক্ষা করে গতকাল শনিবার উচ্চ আদালত আইএলএফএসএলকে নির্দেশ দেন, পিকে হালদার কবে কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন ও দায়বদ্ধতা নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশে ফিরবেন তা নিশ্চিত করতে।
আদালত বলেছিলেন, পিকে হালদার দেশে ফিরে আসার পরে তার জীবনের আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আদালত প্রয়োজনীয় আদেশ প্রদান করবে।
পিকে হালদার ফিরে আসার পর আদালতের হেফাজতে থাকবেন বলে জানিয়েছেন হাইকোর্ট বেঞ্চ।
আইএলএফএস এর পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকও এই অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য দায়ী ছিলেন বলে জানা গেছে দুদকের তদন্ত থেকে।
সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের কারণে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকের ৮৩ জন ব্যক্তি ও সংস্থার অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে।
সূত্র: ডেইলি স্টার