দুর্নীতির ধারণা সূচকে আগের বছরের তুলনায় আরো দুই ধাপ নিচে নেমে এসেছে বাংলাদেশ।
বিবিসি বাংলা জানায়, বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) কর্তৃক পরিচালিত ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২০’-এর বৈশ্বিক প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
১৮০টি দেশের মধ্যে ২০২০ সালে অধঃক্রম অনুযায়ী (খারাপ থেকে ভালো) বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। যা আগের বছর (২০১৯) ছিল ১৪তম।
অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। অন্যদিকে দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে এবারসহ টানা তিন বছর বাংলাদেশ পেয়েছে ২৬।
এর মানে টিআইএ’র তিন সূচকেই বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেনি। করোনাকালে স্বাস্থ্য খাতসহ বিভিন্ন জরুরি সেবায় যে দুর্নীতি হয়েছে, এই সূচকে তার প্রতিফলন রয়েছে।
বাংলাদেশের এই অবস্থান এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়।
জামার্নভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স বা সিপিআই)-২০২০ সালের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বৃহস্পতিবার সারাবিশ্বে একযোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।
এদিন বাংলাদেশে টিআইর সহযোগী প্রতিষ্ঠান টিআইবি এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এবং নির্বাহী ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের প্রমুখ।
দুর্নীতি প্রতিরোধে বেশকিছু সুপারিশ করেছে টিআই। এগুলো হলো-দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দুদককে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া এবং অবাধ গণমাধ্যম ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি করে দুর্নীতিবাজদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতির বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করলে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের নাজেহাল হতে হয়।
ফলে দুর্নীতিবাজরা এতে উৎসাহিত হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আরও কয়েকটি কারণে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-রাজনীতিবিদদের প্রতিশ্রুতির ঘাটতি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবহিদিতার অভাব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অবস্থান সংকুচিত করে দেওয়া।
এছাড়া গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কথা বলার সুযোগ সীমিত করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আর্থিক খাতে একের পর এক কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলেও তাদের বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত নেই। বিচারিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক আনুগত্যের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করার পরামর্শ দেন তিনি।
ড. জামান আরও বলেন, বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত। তবে তা বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর চেয়ে অনেক কম। এটি অত্যন্ত বিব্রতকর ও হতাশাব্যঞ্জক। ক্ষেত্রবিশেষে দুর্নীতির ঘটনা অস্বীকার কিংবা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এছাড়া অবস্থান ও পরিচয় নির্বিশেষে আইনের কঠোর প্রয়োগ হয় না।
করোনার সংকটময় মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। তখন কিছু বিষয় শুধু মৌখিক ঘোষণা দেওয়া হযেছকিন্তু এর প্রয়োগে ঘাটতি আছে। বাস্তবে এটি ঘোষণাতেই আটকে আছে।
বিশেষ করে এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করা যাদের দায়িত্ব, তাদের সঙ্গে দুর্নীতির যোগসাজশ রয়েছে। ফলে তারা সহায়তা করেছে। এছাড়া দুর্নীতির সুবিধাভোগীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশে দুর্নীতি বাড়ছে। অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান যে পর্যায়ে, তার তুলনায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তিনি বলেন, দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আরও রয়েছে-শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে না। আর্থিক খাত, জনবল নিয়োগ এবং বিভিন্ন চুক্তি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতায় ঘাটতি আছে। তাদের মাঝেও দুর্নীতি হচ্ছে।
টিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত স্কোরে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। এক্ষেত্রে গত তিন বছর পর্যন্ত একই অবস্থানে। কিন্তু বিশ্বের সবগুলো দেশের গড় স্কোর ৪৩। এক্ষেত্রে বিশ্বের গড় স্কোরের চেয়ে ১৭ ধাপ পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অর্থাৎ দুর্নীতির ব্যাপকতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে আফগানিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এছাড়া এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ। বাংলাদেশের মতো একই স্কোর পেয়েছে সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং উজবেকিস্তান।
সংবাদ সম্মেলনে ড. জামান আরও বলেন, বিশ্বের বেশকিছু দেশে নাগরিক স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় দুর্নীতি বাড়ছে। বাংলাদেশেও এই প্রবণতা দেখা যায়। আর যেসব দেশে গণমাধ্যম ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কম সুরক্ষা পায়, ওইসব দেশে দুর্নীতি বেশি।
টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, আইন প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান অনৈতিক প্রভাব বিস্তার, অনিয়ম ও দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা যায়নি।
প্রতিবেদন অনুসারে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে যৌথভাবে রয়েছে সিঙ্গাপুর, সুইডেন, নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড। সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া এবং দক্ষিণ সুদান। এরপরই রয়েছে সিরিয়া, ইয়ামেন, ভেনিজুয়েলা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। উপরের দিকে দেশটির অবস্থান ৬৮। এরপর ভারত ৪০, শ্রীলংকা ৩৮, পাকিস্তান ৩১, মালদ্বীপ ৪৩, নেপাল ৩৩ এবং আফগানিন্তান ১৯তম অবস্থানে।
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের অস্বীকৃতির মানসিকতা বিরাজ করছে। কোনো কর্মকর্তার দুর্নীতির কথা বললে, সেটি অস্বীকার করা হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এক্ষেত্রে হয়রানি ও নাজেহাল হতে হয়।
এটি গণমাধ্যমকর্মী ও নাগরিক সমাজ সবার জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কাজের ক্ষেত্র ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে। এটি দুর্নীতি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত বড় প্রতিবন্ধকতা।
মানুষের কণ্ঠস্বর প্রকাশ করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে এই অধিকার সংকুচিত হয়েছে। তাই সংসদের প্রথম অধিবেশনেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করতে হবে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা রয়েছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত।
আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ, জালিয়াতি এবং সরকারি কাজে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ইত্যাদি কারণে অবস্থানের উন্নতি হয়নি।
দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় আনতে দুদক ভূমিকা সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুদক দুর্নীতিবাজদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা একটি সীমারেখার মধ্যে। রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দুদকের সক্রিয় ভূমিকার ঘাটতি রয়েছে।
তাই সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির পরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। এছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান এমনভাবে রাজনীতিকীকরণ হচ্ছে, যাতে সেগুলোকে এখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে হচ্ছে, এগুলো ঢেলে সাজানো দরকার। সূচকে এসবের প্রভাব পড়েছে।
প্রতিবেদনে ২০১৯-২০২০ পর্যন্ত তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। জরিপগুলোতে মূলত ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, সংশ্লিষ্ট খাতের গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের ধারণার প্রতিফলন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যসূত্র হিসেবে ৮টি জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।
এগুলো হলো- বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম এক্সিকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে, গ্লোবাল ইনসাইট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস, বার্টেলসম্যান ফাউন্ডেশন ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল’, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেস ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস এবং ভ্যারাইটিস অব ডেমোক্রেসি প্রজেক্ট ডাটাসেট রিপোর্ট। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবির কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্যও এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই টিআইবি ধারণা সূচক দেশীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে।