দেখতে দেখতে ২০২১ সালের চতুর্থ মাস এসে গেল। সামনে পবিত্র রমজান শুরু হবে। কয়েকদিনের রাজনৈতিক খবর বাদে সব কাগজেই গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের খবর। পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে একশ্রেণির ব্যবসায়ী প্রায় সব ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।
কোনো রাজনৈতিক দলও এখন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আর আগের মতো প্রতিবাদ করে না। অবশ্য প্রতিবাদ করেও কোন লাভ হয় না। তার মানে কী? সবাই কি ধরে নিয়েছেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাবেই? এর থেকে রেহাই নেই? প্রত্যেক বাজেটের সময়, পবিত্র রমজান ও কোরবানির ঈদের সময়, শীতকালে পিকনিকের সময়, বন্যা ও খরার সময়, সরবরাহ ঘাটতি ও উৎপাদন ঘাটতির সময়, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সময়সহ নানা সময়ে নানা অজুহাতে ব্যবসায়ী ভাইয়েরা মূল্যবৃদ্ধি ঘটাবেন। নিয়মিতভাবে তা করবেন তারা। পবিত্র ধর্মীয় উৎসবে সাধারণ মুসল্লিদের কথাও চিন্তা করেন না। যদি করতেন তাহলে আর দুদিন বাদেই যখন পবিত্র রমজান মাস, তখন তারা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে একটু স্বস্তি দিতেন। না, তা হওয়ার নয়। বাজারে সব ভোগ্যপণ্যের মূল্য ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। চাল, গম, আটাও বাদ নেই। সরকারের গুদামে ১৩-১৪ লাখ টনের স্থলে ৪-৫ লাখ টন চাল আছে-এ খবরের সুবাদে চালের মূল্য ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছেন আজ দু-তিন মাস ধরে। চিনি, সয়াবিন তেল, ময়দা, ছোলা, খেজুর, মসলাপাতি, মুরগিসহ এমন কোনো দ্রব্য নেই, যার মূল্য বাড়েনি, বাড়ছে না। অথচ কেউ এখন আর প্রতিবাদ করছে না। মনে হয় সবাই ধরে নিয়েছেন এটাই নিয়তি, এর থেকে রেহাই নেই।
এখানে প্রশ্নটা হচ্ছে: দ্রব্যমূল্য যখন বাড়বেই, তা যখন কমার কোনো কারণ নেই, তাহলে সেই অনুপাতে আয় বাড়ানো হোক, বেতনভাতা বাড়ানো হোক। অথবা আরেকটি বিকল্প হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহনীয় মূল্যে মানুষকে সরবরাহ করা হোক। অন্তত গরিব, মধ্যবিত্ত, বেওয়া-বিধবা, বেকার লোকজনদের মধ্যে যাতে তারা খেয়ে-পরে বাঁচতে পারে। যেমন, প্রতিবেশী ভারতের কথা বলা যায়। সেখানে দুই ধরনের রেশন কার্ড আছে বলে শুনেছি। দারিদ্র্যসীমার ওপরে যারা তাদের এক ধরনের কার্ড এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে যারা তারা সারা বছর ১-২ রুপিতে এক কেজি গম/চাল পায় বলে কাগজে দেখেছি। আমাদের এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা নেই।
করোনাকালীন গত এক বছরে লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার ও কর্মহীন হয়েছে। কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। অগণিত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। শহরের দারিদ্র্য গ্রামের চেয়ে বেশি বেড়েছে। মানুষের হাতে ‘ক্যাশ’ নেই, কাজ নেই। এখন নতুন করে করোনা-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। বর্তমানের করোনা এক বছর আগের চেয়ে ভয়াবহ। প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে কোনো জায়গা নেই, রোগীদের অক্সিজেন নেই; যা-ও অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল তাতেও ছেদ পড়েছে। সামনে বাজেট। আর মাত্র দুই মাস বাকি। জুন মাসে বাজেট দেওয়া হবে। অর্থনীতির ‘পারফরমেন্স’ কী হবে, তা এখনই সঠিক বলা যাচ্ছে না। করোনার নতুন আঘাত অর্থনীতি কতটুকু সহ্য করতে পারবে তা অনিশ্চিত। রপ্তানি, আমদানি, রেমিটেন্স ও রাজস্ব ইত্যাদি স্বাভাবিক হয়ে আসছিল; কিন্তু এসবেও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। এর অর্থ রোজগারের বাজার আবারও অস্থিতিশীল হওয়ার আশঙ্কা।
করোনা থেকে বাঁচার পথ গ্রহণ করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে মানুষের আয় কমে যাবে। এমনিতেই বাজার মন্দা। তাহলে মানুষের ভাতের ব্যবস্থা কী? আয়ের ব্যবস্থা না-থাকলে ভাতের ব্যবস্থাও বিঘ্নিত হবে। এ দুয়ের মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিষয়টি আরও মর্মান্তিক। সারা বিশ্বে যখন হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, লাখ লাখ লোক করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, যখন মানুষকে বাঁচানোর জন্য টিকার সরবরাহ প্রতুল, তখন বিশ্বের তাবৎ ধনীর সম্পদ ২০২০ সালে বেড়েছে। একই অবস্থা আমাদেরও। আমাদের ব্যবসায়ীরা কোনো সুযোগ ছাড়ছেন না। তারাও সামান্য অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে যাচ্ছেন। সমস্যাটা তো এখানেই, দ্রব্যমূল্য বাড়ছে অথচ মানুষের আয় নেই, আয় সেভাবে বাড়ছে না, অন্যদিকে ধনীদের-ব্যবসায়ীদের আয় স্ফীতি হচ্ছে। এ অবস্থায় সবার সামনেই প্রশ্ন: জীবন ও জীবিকার। জীবন বাঁচাতে রোগ থেকে যেমন রক্ষা পেতে হবে, তেমনি দরকার জীবিকা/আয় তথা ইনকাম। এর ব্যবস্থা কী? দৃশ্যত কোনো বিকল্প দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে যদি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিটা ঠেকানো যেত, তাহলেও কিছটা রক্ষা পাওয়া যেত। না, তা হওয়ার নয়।
শাকসবজি, মাছ-মাংস কোনোটারই দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই। এভাবে প্রতিটি জিনিসের মূল্য বেড়ে চলেছে। অথচ আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা জিনিসপত্রের দাম কমবে না। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, মানুষের আয়ও সমানুপাতে বাড়ছে না। নতুন কর্মসংস্থাও সেভাবে সৃষ্টি হচ্ছে না। যাদের চাকরি আছে তাদের চাকরিও যাচ্ছে। সেদিনই খবর পেলাম একটা বড় গ্রুপের হিসাবরক্ষণ বিভাগে ৬০ জন কর্মচারী-কর্মকর্তা ছিল; ৩৫ জনকেই ছাঁটাই করা হয়েছে। সুতরাং সামনে কি হতে যাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
যুগান্তর পত্রিকা থেকে কিঞ্চিত সংক্ষেপিত
এ সবই গণতন্ত্রের ফসল। গণতন্ত্র থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।