ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীর, নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে পাহাড় ঘেঁষে নদী বয়ে যাওয়া কিংবা সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ মাঠ। আগুন্তকদের জন্য স্থানটি হল স্বপ্নের দেশ দেখার মতো অভিজ্ঞতা।
তবে সেখানকার মুসলিমদের জন্য কাশ্মীরকে ভয়ঙ্কর এক নরক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। চারিদিকে শুধু রক্ত, লাশ আর পোড়া বারুদের গন্ধ। হিন্দুত্ববাদী ভারত তার সামরিক শক্তির প্রায় পুরোটাই ব্যয় করছে নিরীহ কাশ্মীরি মুসলিমদের জীবনে বিভীষিকা নামিয়ে আনতে। হত্যা, গুম, ধর্ষণ, অত্যাচার সেখানে নিত্য দিনের ঘটনা।
গত তিন দশকে দখলকৃত কাশ্মীরে হিন্দুদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের কারণে ব্যাপক সহিংসতা চালাচ্ছে ভারত।
১৯৮৯ সাল থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাশ্মীরে হিন্দুত্ববাদী ভারত কর্তৃক নির্যাতনের উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিস। এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায় এই ৩০ বছর সময়ে ভারতীয় বাহিনীর হাতে-
১) খুন হয়েছে ৯৫ হাজার ৭৪৭ জন
২) যৌন নির্যাতন/গধর্ষণের শিকার হয়েছে ১১ হাজার ২৩৫ জন নারী
৩) গ্রেফতার হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪৭০ জন
৪) কারাগারে খুন হয়েছে ৭ হাজার ১৬৬ জন
৫) ইয়াতীম হয়েছে ১ লাখ ০৭ হাজার ৮১৩ শিশু
৬) বিধবা হয়েছে ২২ হাজার ৯২৪ জন নারী
৭) ধ্বংস হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৩৩৮ টি স্থাপনা
কাশ্মীরি নারী-পুরুষ উভয়কেই দমিয়ে রাখতে ভারতীয় বাহিনীর বহুল ব্যবহৃত একটি জঘন্য হাতিয়ার হলো ধর্ষণ, যার প্রকৃত সংখ্যা প্রতিবেদনে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশী। কেননা বেশীরভাগ ঘটনাই রিপোর্ট করা হয়না, কিংবা অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য প্রমাণ মুছে ফেলা হয়। তাছাড়া সেখানে গণমাধ্যমের উপর রয়েছে কড়া নজরদারি।
১৯৯৩ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) রিপোর্ট অনুসারে, কাশ্মীরি নাগরিকদের বিদ্রোহের প্রতিশোধ হিসেবে ধর্ষণকে বেছে নেয় ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী বাহিনী। বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটছে তল্লাশির সময়। এইচ.আর.ডাব্লিউ এর ১৯৯৬ রিপোর্টেও অনুরূপ তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সেখানে ভারতীয় বাহিনীর ধর্ষণের ঘটনার কোনো হিসাব নেই। ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হলেও এর বিচার হয় না। আবার লোকলজ্জায় অনেকে ধর্ষণের ঘটনা বলতেই চায় না।
পণ্ডিত ইঙ্গার সখজেলসবেইক বলেছে, সৈন্যরা যখন বেসামরিক বাড়িতে প্রবেশ করে, তখন মহিলাদের ধর্ষণ করার আগে বাড়ির পুরুষদের হত্যা বা গ্রেফতার করে। পণ্ডিত শুভ মাথুর ধর্ষণকে কাশ্মীরে ভারতীয় সামরিক কৌশলের অপরিহার্য উপাদান বলে অভিহিত করেছে। পণ্ডিত সীমা কাজির মতে, কাশ্মীরি পুরুষদের দমানোর হাতিয়ার হিসেবে ভারতীয় সেনারা মহিলাদের ধর্ষণ করে এবং কাশ্মীরি জনগণের প্রতিরোধের মনোবল ভেঙে দিতেই তারা ধর্ষণকে বেছে নিয়েছে।
কাশ্মীরের দোদা জেলার লুদনা গ্রামের ৫০ বছর বয়সী এক নারী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে জানান যে, ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের সদস্যরা তাঁর বাড়ি থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় এবং প্রহার করে। এরপর একজন হিন্দু ক্যাপ্টেন তাঁকে ধর্ষণ করে এবং বলে যে, “তোমরা মুসলিম, এবং তোমাদের সকলের সাথে এমন আচরণ করা হবে।”
এছাড়া একটি হিসেব বলছে, প্রতিদিন ভারতে গড়ে ১০০টি’র বেশি ধর্ষণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়৷ বছরে যা ৪০,০০০-এর বেশি৷ প্রতি ১০টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে অন্তত ৪টির শিকার নাবালিকারা৷ যে নাবালিকা শিশুদের মাঝে আসিফাও ছিল। যাকে হিন্দুত্ববাদীরা মন্দিরে রেখে গণধর্ষণ করে মাথা থেতলে দিয়েছিল। তাকে এক সপ্তাহ ধরে আটকে রেখে ধর্ষণ করার পর পাথর ছুড়ে হত্যার আগে আবারও ধর্ষণ করা হয়েছিল।
জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া জেলার রাসানা গ্রামে আসিফাকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। এতে নেতৃত্ব দেয় স্থানীয় মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জি রাম, স্পেশাল পুলিশ কর্মকর্তা দীপক খাজুরিয়া ও সুরেন্দ্র বর্মা, সাঞ্জি রামের বন্ধু পরভেশ কুমার ওরফে মন্নু, রামের নাবালক ভাতিজা ও ছেলে বিশাল জঙ্গোত্র ওরফে শম্মা। কত জঘন্য চিন্তা করুন- বাপ, ছেলে, ভাতিজা, বন্ধু মিলে এক মুসলিম নাবালিকাকে তাদের উপসানালয় মন্দিরে রেখে গণধর্ষণ করেছে, পরে মাথা থেতলে হত্যা করেছে।
এই বর্বরোচিত ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত মন্দির তত্ত্বাবধায়ক সাঞ্জি রাম তদন্ত কর্মকর্তাদের ঘটনার তদন্ত প্রভাবিত করতে ঘুষ দেয়। এ বিষয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, তদন্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে হেড কনস্টেবল তিলক রাজ ও সাব-ইন্সপেক্টর আনন্দ দত্ত অভিযুক্ত সাঞ্জি রামের কাছ থেকে চার লাখ রুপি ঘুষ দিয়ে ঘটনার প্রমাণ নস্যাৎ করেছে।
এমনিভাবে, ভারত দখলকৃত কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামী কমান্ডার বুরহান ওয়ানিকে শহীদ করে দেওয়ার পর কাশ্মীরী জনগণ ব্যাপক বিক্ষোভে নামে। ওই বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনীগুলি ব্যাপকহারে ছররা গুলি ব্যবহার করেছিল। এক মাসে প্রায় সাড়ে ১৩ লক্ষ ছররা ব্যবহার হয়েছিল। একই সময়ের মধ্যে সাড়ে আট হাজার কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটিয়েছিল দখলদার ভারতীয় বাহিনী।
২০১৬ সালের ৮ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভে শুধু এক মাসেই মোদির সন্ত্রাসী বাহিনী ৬৬ জন মুসলিমকে হত্যা করে। মানবাধিকার সংগঠনগুলি বলছে সবথেকে বেশী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ছররা গুলিতে। বহু মানুষ আহত হয়েছেন, অনেকে অন্ধ হয়ে গেছেন।
একসময়ে শিকার করার জন্য এধরণের ছররা গুলি ব্যবহার করা হত। ছোট ছোট ধাতব বলের ভেতরে বারুদ ভরে তারপরে প্লাস্টিকের আচ্ছাদন দিয়ে একেকটি ছররা তৈরি হয়। একেকটি কার্তুজে সাড়ে চারশো ছররা থাকে – যেটা বন্দুক থেকে ছোঁড়া হলে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভকারীদের আহত করে।
পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি দীর্ঘসময় ধরে ভারতীয় সনবিধানে কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা সম্পর্কিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ’এর বিরোধিতা করে আসছিল। ঐ অনুচ্ছেদের বিলোপ সাধন বিজেপি দলের ২০১৯ সালের নির্বাচনি তফসিলের অংশও ছিল। এপ্রিল-মে মাসে হওয়া সাধারণ নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর ৫ আগস্ট ২০১৯ তারিখে নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট সরকার ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫(এ) ধারা পার্লামেন্টের দুই কক্ষের ভোটে বাতিল করে দেয়। এর মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে কাশ্মীরের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা বাতিল করা হয়। কাশ্মীরকে বিভক্ত করা হয় জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ- এ দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে।
সেইসাথে কাশ্মিরের আজাদী চাওয়া মুসলিমদের রুখতে মোদি সরকার মোতায়েন করেছিল অতিরিক্ত হাজার হাজার সেনা। করোনা আক্রমণ শুরু হওয়ার এক বছর আগেই কাশ্মিরের মানুষকে কারফিউ জারি করে যে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল, সেই বন্দিত্ব আজ পর্যন্ত চলমান।
কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারত যে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাঈলকে নিজদের রোল মডেল হিসেবে নিয়েছে, তা বেশ কয়েকজন অফিয়সিয়ালের বক্তব্যে উঠে এসেছিল। মোদি সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরী মুসলিমদের উপর নির্যাতনের মাত্রা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কাশ্মীরের সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অংশ এবং দুনিয়ার সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। কাশ্মীরে ভারতীয়দের জমি কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানা, চাকরি নিষিদ্ধ ছিল। এখন ভারতীয়রা সেখানে জমি কিনতে পারবে, ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্পে বিনিয়োগ করতে পারবে, চাকরি করতে পারবে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের লোকদের জন্য নানা ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে কাশ্মীরিদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও পেছনে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া এক্ষেত্রে তাদের একটা বড় চক্রান্ত হচ্ছে, কাশ্মীরে ভারতীয় হিন্দুদের বসতি স্থাপন করে সেখানে মুসলিমদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা।
২০১৫ সালে আল জাজিরাতে সাংবাদিক মেহেদী হাসানকে সাক্ষাতকার দিয়েছিল মোদীর জনতা পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব। সে সুস্পষ্টভাবে বলে তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানকে একত্রিত করে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা করা। বিজেপির মূল শেকড় হল আরএসএস। সেই আরএসএস এর প্রধান মোহন ভগবত বলেছে উপমহাদেশে অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
ভারতের নীতি নির্ধারকরা বেশ স্পষ্টভাবেই তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য জানিয়ে দিয়েছে। তাদের কল্পিত অখন্ড ভারতে থকবে শুধু হিন্দুরা। মুসলিমরা সেখানে থাকবে না বা থাকতে দেওয়া হবে না। কাশ্মীর, আসাম, গুজরাট, দিল্লীতে মুসলিম নিধন, বাংলাদেশের প্রশাসন সহ সর্বস্তরে হিন্দুদের আধিপত্য… সবকিছুই অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। হিন্দুত্ববাদী ভারতের এই অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আবর্তিত হচ্ছে গুজরাটের কসাই মোদীকে কেন্দ্র করে।
তথ্যসূত্র:
[১] ধর্ষণ যখন অস্ত্র : কাশ্মীরে নারী নির্যাতনের দীর্ঘ ইতিহাস- https://tinyurl.com/4swwprcz
[২] Under Siege: Doda and the Border Districts”, Human Rights Watch – https://tinyurl.com/t9zd52tj
[৩] ধর্ষণ, ধর্ষণ নিয়ে রাজনীতি এবং দেশজুড়ে আতঙ্ক- https://tinyurl.com/536vu9rs
[৪] আসিফা বানু ধর্ষণ-হত্যা; কাশ্মিরিরা কি এভাবেই পঁচে মরবে?- https://tinyurl.com/6cptffny
[৫] হত্যার আগেও ধর্ষণ থেকে রেহাই পায়নি শিশু আসিফা: https://tinyurl.com/byp4cyw
[৬] রক্তাক্ত কাশ্মীর, বিজেপি সরকারের নীতি কতটা দায়ী? https://tinyurl.com/56tzfwcw
[৭] ৩৭০ ধারা বাতিলের আগে ও পরে, জেনে নিন এই তথ্যগুলো: https://tinyurl.com/28u6yh3w
[৮] HR Violations, Kashmir Media Service- https://kmsnews.org/news/
[৯] BJP official backs India-Pakistan-Bangladesh unity- https://tinyurl.com/8e93rw3b