কাশগড়ে উইঘুরদের ঐতিহ্যবাহী বাজার ধ্বংস করছে চীন

0
210
[উইঘুরদের শতাব্দী পুরোনো ঐতিহ্যবাহী খান বাজার।]

কাশগড়ের শত বছরের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী একটি সমৃদ্ধ বাজার হচ্ছে ‘খান বাজার’। বাজারের মাঝখান দিয়ে গেছে পথচারীদের জন্য তৈরি রাস্তা। আধুনিক পর্যটকরা সেই রাস্তা দিয়ে পায়চারি করছেন। আর কাপড়ের দোকান নিয়ে বসেছেন উইঘুর ব্যবসায়ীরা—এমন সব প্রাণবন্ত দৃশ্য চোখে ভাসছে কাসিমজান আব্দুর রহিমের।

আরও উন্নত ও আধুনিক করার নামে বাজারটি ধ্বংস করতে শুরু করেছে চাইনিজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু আব্দুর রহিম ও তাঁর মতো উইঘুররা বিশ্বাস করেন, চাইনিজ কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপ মূলত উইঘুর মুসলিম জাতির নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করারই আরেকটি প্রচেষ্টা।

টিকটক অ্যাপে ছড়িয়ে পড়া একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিওতে দেখা যায়, অধিকাংশ দোকানের সিঁড়ি, জানালা এবং দরজাগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। বাজার রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষও বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
‘তারা পুরোনো কাঠামো ধ্বংস করে নতুন কাঠামো নির্মাণ করছে। নতুন এই কাঠামো ভূমিকম্প প্রতিরোধী হবে বলে তাদের দাবি,’ বলছেন আব্দুর রহিম। ৪০ বছর বয়সী এই উইঘুর এখন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াতে রিয়াল অ্যাস্টেট অ্যাজেন্ট হিসেবে কর্মরত আছেন।

উইঘুরদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ধ্বংসের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০২২ সালে জিনজিয়াংয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বৃহৎ বাজার কাশগড়ের ‘গ্র্যান্ড বাজার’ ধ্বংস করেছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। বাজারটিতে উইঘুর স্বাতন্ত্র্যসূচক যে সকল বৈশিষ্ট্য ছিল, তার কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি কর্তৃপক্ষ।

একই পরিণতি হচ্ছে খান বাজারের। এভাবে বাজার ধ্বংসের ফলে নিজেদের ব্যবসা চিরতরে হারানোরও আশঙ্কা আছে। এ নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের সাথে বিবাদেও জড়িয়েছিলেন কিছু উইঘুর।

ফলশ্রুতিতে পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তাদের একজন হলো বাহতিয়ার; বয়স ১৬। এই তরুণের বাবাকেও ২০১৭ সাল থেকে চীনা কর্তৃপক্ষ বন্দী করে রেখেছে। বাবার অনুপস্থিতিতে বাহতিয়ার সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলোতে তার মাকে দোকান পরিচালনায় সাহায্য করে আসছিল।

জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের অবকাঠামো ধ্বংসের কারণে অনেক পরিবার তাদের বসতবাড়ি, ব্যবসা এবং আবাদী জমি হারিয়েছেন। কথিত আধুনিকায়নের নামে চীনা কর্তৃপক্ষের চালানো এসব ধ্বংসযজ্ঞের কারণে উইঘুর জাতি তাদের মসজিদ, প্রাচীন বাজার, নিজেদের ঐতিহ্যবাহী স্বকীয়তা হারাচ্ছেন।
চীনা কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা ‘খান বাজার’ ধ্বংস করছে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। তবে তাদের এই দাবিকে নাকচ করে আব্দুর রহিম বলেন, ‘এটা বাস্তবতার সাথে যায় না।’

তিনি বলেন, ১৯৮০ সাল থেকেই নানা সময় বিভিন্ন বাহানায় বাজার সংস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। ২০০০ থেকে ২০১০ এর মধ্যেও এমন একটি কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। এমন প্রতিটি সংস্কার কার্যক্রমেই কিছু উইঘুর তাদের বাড়ি এবং দোকানপাট হারিয়েছেন। কারণ তারা সংস্কারের ফি দিতে সক্ষম না। ফলে উইঘুরদের এসব সম্পদ নাম মাত্র মূল্যে কিনে নেয় চীনা ব্যবসায়ীরা। আব্দুর রহিম রেডিও ফ্রি এশিয়াকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা সরকারের পরিকল্পিত চক্রান্ত।’

পনেরো শতাব্দী থেকে এই বাজার বসে এখানে। সামনে ইদকাহ মসজিদ। ২০১৬ সাল থেকে এই মসজিদটিও বন্ধ করে রেখেছে চীনা সরকার। উইঘুরদের ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর চীনা ক্র্যাকডাউনের নিদর্শন এগুলো। ইদকাহ মসজিদ থেকে দেখা যায় ব্যস্ত খান বাজার। আব্দুর রহিম ২০১৭ সালে সর্বশেষ এই স্থানটি দেখেছিলেন। এরপর তিনি বাণিজ্য ভ্রমণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে আর ফিরে আসেননি।

যেসব উইঘুর পরিবার জিনজিয়াংয়ে রয়ে গেছেন, তারা খান বাজার সংস্কার কার্যক্রমের কারণে চিন্তিত। দোকান হারানোর ভয় তাদের মনে। চীনা সরকারের নির্ধারিত সংস্কার ফি দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। কারণ তাদের পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তিদের ইতঃপূর্বেই ক্যাম্পে বা কারাগারে বন্দী করে রেখেছে চীনা সরকার। এমন তথ্য জানিয়েছেন নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি।

নির্যাতনের ভয়ে নিজেদের উদ্বিগ্নতার কথা জানাতেও পারেন না উইঘুররা। তবু গোপনে যতটুকু দুঃখ প্রকাশ করেন, তাও রাজনৈতিক নেতাদের কানে চলে যায়। ফলে বাজার ধ্বংসের সময় দোকান মালিকদের নজরদারিতে রাখে চীনা কর্তৃপক্ষ। এক পুলিশ সদস্যের সূত্রে রেডিও ফ্রি এশিয়া জানায়, দোকান মালিক ও বাসিন্দাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার দিকে নজর রাখতে নির্দেশনা জারি করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ, উইঘুরদের ঘর, দোকান ভেঙ্গে ফেলার সময় কোনো ধরনের প্রতিবাদ করা যাবে না। সবকিছু নীরবে সয়ে যেতে হবে তাদের।

তথ্যসূত্র:
—–
Demolition of Kashgar’s Khan Bazaar creates uncertain future for Uyghur shop owners – https://tinyurl.com/mvxfy6mp

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধপশ্চিম তীরে দখলদার ইসরাইলি বাহিনীর বর্বর অভিযান, ২ ফিলিস্তিনি নিহত
পরবর্তী নিবন্ধসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌত্তলিক মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক