ইয়াসিন উজতুর্ক, একজন উইঘুর মুসলিম। এখন ইস্তাম্বুলে একটি নাপিতের দোকান চালান। তিনি কখনও ভাবেননি, তুরস্কে অবস্থান করেও চীনা গোয়েন্দা বাহিনীর টার্গেটে পড়বেন। চীনে রয়ে যাওয়া তার পিতামাতার ব্যাপারে ভয়ে থাকতেন তিনি। এজন্য চীনের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো কথাও বলতেন না এবং এ সংক্রান্ত রাজনৈতিক বিক্ষোভও এড়িয়ে চলতেন। তবুও চীনের নজর এড়াতে পারলেন না।
একদিন তিনি দেখলেন, এক কাস্টমার তার অজান্তেই রাস্তা থেকে তার ছবি তুলছে। সেই লোকটিও উইঘুর। তিনি লোকটিকে বাধ্য করলেন তার ফোন দেখাতে। ফোন ঘেঁটে পাওয়া গেল ইয়াসিন উজতুর্কের দোকানের ছবি। আরও পাওয়া গেছে কিছু ভয়েস মেসেজ। চীনের কোনো এক সিকিউরিটি কর্মকর্তার ভয়েস মেসেজ হবে মনে হচ্ছে। ভয়েস মেসেজে উজতুর্কের ব্যাপারে আরও তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ‘কাজটি শেষ করার’ জন্য ভীতিকর নির্দেশও রয়েছে সেখানে।
‘আমি নিরাপদ নই। চীনের হাত এখানে সব জায়গায় পৌঁছে গেছে’, বলছিলেন উজতুর্ক। ৩৮ বছর বয়সী উজতুর্ক ২০১৬ সাল থেকে ইস্তাম্বুলে বাস করছেন। ‘এখানে প্রত্যেকেই একে অপরের জন্য সন্দেহজনক’, বলছিলেন উজতুর্ক।
ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড থেকে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী, উজতুর্কের এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চীনের বাইরে বসবাসকারী হাজার হাজার উইঘুরদের সাথেও এমন ঘটছে। তুরস্কে বসবাসকারী অন্তত ১২০ জন এবং যুক্তরাজ্যের আরও বেশ কয়েকজন উইঘুরের কাছ থেকে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে। উইঘুরদের সম্পর্কে তথ্য নিতে চীনা পুলিশ উইঘুরদেরকেই একে অপরের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতে বাধ্য করছে বিভিন্ন ভাবে।
প্রায় ছয় বছর আগে থেকে উইঘুর ও অন্য তুর্কি মুসলিম জাতির উপর গণগ্রেফতারি চালিয়ে আসছে চীন সরকার। পুনঃশিক্ষার নামে মুসলিমদেরকে কাফের বানানোর সকল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং সকল প্রকারের নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে তারা।
এখন নিজেদের সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া উইঘুরদের উপরও নজরদারি চালাচ্ছে চীন সরকার। অ্যাকাডেমিকরা এর নাম দিয়েছেন ‘আন্তর্জাতিক নিপীড়ন’ (Transnational Repression)।
এই নব্য দমননীতির মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত উইঘুরদের উপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে জিনজিয়াংয়ে চলমান অত্যাচারের বিরুদ্ধে তাদেরকে চুপ করিয়ে দিতে চেষ্টা করছে চীন। এক্ষেত্রে উইঘুরদের উপর চাপ প্রয়োগের জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় চীনে রয়ে যাওয়া তাদের পরিবার-পরিজনকে। বিদেশে অবস্থানরত উইঘুররা চীনা প্রশাসনের কথা মতো কাজ না করলে, তাদের পরিবারের উপর অত্যাচার চালানোর হুমকি দেওয়া হয়। পাশাপাশি, চীনকে সহায়তা করলে প্রিয়জনদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
চীনের সাথে বন্ধু-ভাবাপন্ন সরকারগুলো এসব জেনেও চুপ করে থাকে এবং উইঘুরদের সাহায্য করা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। যুক্তরাজ্যে বসবাসরত উইঘুররা জানিয়েছেন, যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তারা এসব বিষয়ে কোনো সহায়তা পাচ্ছেন না। ফলে, চীনের নতুন এই দমননীতির কারণে বিদেশে অবস্থানরত উইঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জেগে ওঠা ও তাদের মাঝে বিভাজন তৈরির আশংকা দেখা দিচ্ছে।
উইঘুর অভিবাসীদের অধিকাংশই বাস করেন এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। কাজাখস্তানে তাদের সংখ্যা প্রায় ২৯০০০০, কিরগিজিস্তানে ৬২০০০ এবং উজবেকিস্তান ও তুরস্কে প্রায় ৫০০০০ করে। আর যুক্তরাষ্ট্রে উইঘুর আছেন ১০ থেকে ১৫ হাজারের মতো।
তুরস্কে বসবাসকারী উইঘুরদের মধ্যে যাদের সাক্ষাতকার নেওয়া হয়, তাদের ৫ ভাগের ৪ ভাগই জানিয়েছেন যে, তাদেরকে চীনা পুলিশ বা রাষ্ট্রীয় সিকিউরিটি অফিসাররা ফোনের মাধ্যমে হুমকি দিয়েছে। প্রায়ই তারা চীনে অবস্থানরত উইঘুর পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছে, কখনও জিনজিয়াংয়ে রয়ে যাওয়া পরিবারকেও হুমকি দিয়েছে।
প্রায় ৫ ভাগের ৩ ভাগকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া অথবা নিরাপদে চীনে বসবাসের নিশ্চয়তা প্রদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে তাদেরকে জিনজিয়াংয়ে ঘটে চলা চীনা সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে চুপ থাকতে বলা হয়েছে।
সাক্ষাতকারদাতা সকল উইঘুর বলেছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে চীনা নজরদারির শিকার হয়েছেন। অন্তত তিন উইঘুর রেস্টুরেন্ট মালিক জানিয়েছেন, চীনা পুলিশ তাদেরকে চাপ দিয়েছে তাদের কাস্টমারদের ছবি তুলে রাখতে এবং গতিবিধি মনিটর করতে।
চীনের এমন নজরদারির কারণে অভিবাসী উইঘুর সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহের দানা বাঁধছে। একে অপরকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে বলেও জানিয়েছেন অনেক সাক্ষাতকারদাতা।
তথ্যসূত্র:
——–
1. ‘The hand of China reaches here’: how Beijing pushes Uyghurs to spy on each other overseas
– https://tinyurl.com/yck3jhyw
2. “We know you better than you know yourself”: China’s transnational repression of the Uyghur diaspora – https://tinyurl.com/vur6zbhz