আসামের মরিগাঁও জেলায় সাদ্দাম হুসাইন নামের এক মুসলিমকে পিটিয়ে হত্যা এবং অপর কয়েকজনকে গুরুতর আহত করেছে হিন্দু জনতা। গত ২৫ জুলাই কেন্দ্রীয় আসামের মরিগাঁও জেলার আহতগুরি গ্রামে এই ঘটনা ঘটে।
নিহত সাদ্দাম তার পাঁচ সাথী সহযোগে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরের নরমারি গ্রাম থেকে স্থানীয় কাবাডি লীগের ফাইনাল খেলা দেখে বাইকে করে নিজ বাড়ি আহতপাম গ্রামে ফিরছিলেন। পথিমধ্যে আহতগুরি গ্রামের হিন্দু জনতা গাভী চুরির অভিযোগ তুলে তাদেরকে মারধোর শুরু করে। তখন হুসেনের সাথী আনারুল হক, সামসুল হক এবং আবুল হুসাইন পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও, জনতার পিটুনিতে প্রাণ হারান সাদ্দাম হুসাইন; গুরুতর আহত হন বিলাল হুসাইন ও মিরাজুল হক।
সাদ্দাম হুসাইনের সাথী আনারুল হক এই অঞ্চলের একজন সুপরিচিত ফুটবল খেলোয়াড়। তার ভাই মিরাজুল হকও গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়েছেন। অথচ তারা কেউই অত্র এলাকায় অপরিচিত কোন মুখ ছিলেন না।
আনারুল হক মাক্তুব মিডিয়াকে বলেন, “আপনি হয়তো বলতে পারেন যে আমাকে তারা চিনতে পারে নি, অথচ আমি ফুটবল খেলায় ভাল হওয়ার কারণে এলাকায় তারা আমাকে মেসি হিসাবে চেনে।”
আক্রমণের শুরুর বর্ণনা দিতে গিয়ে আনারুল বলেন, “খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমরা আমাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম এবং সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে (মঙ্গলবার সকালে) আহতগুরিতে পৌঁছি। বৃষ্টি হচ্ছিল বিধায় আমরা রাস্তার ধারে একটি টিনের ছায়ার নীচে থামলাম। ঠিক সেই মুহুর্তে ৭-৮ জনের একটি দল আমাদের ঘেরাও করে। তাদের মধ্যে একজন বলেছিল ‘যে আপনি মেসি না?”
আনারুল যেহেতু নিশ্চিত হয়েছিলেন যে প্রত্যেকে তাকে চেনে, তাই তিনি তার পরিচয় নিশ্চিত করে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দেন।
তিনি বলেন, “তারা আমাদের প্রত্যেককে চিনত। তবুও তারা আমাদের বিরুদ্ধে গরু চুরির অভিযোগ করেছে। তখন আমি বলেছিলাম যে আমরা চোর নই এবং কাবাডি ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম; আর এটি তাদেরকে যাচাই করে দেখতেও বলি। কিন্তু তারা আমাকে এত জোরালোভাবে আঘাত করেছিল যে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।“
পরে আরও লোকজন আক্রমণকারীদের সাথে যোগ দিয়ে তাদের মারধরে শরীক হয়েছিল।
আনারুল বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আমাদের শেষ করে দেওয়া। তাই আমি আমার সাথীদের সবাইকে জীবন বাঁচানোর জন্য পালাতে বলি। যদিও আমি সবকিছু ঝাপসা দেখছিলাম, তবু আমি তাদের বলছিলাম যে, তোমরা নিজেদের জীবন বাঁচাতে আমাকে অনুসরণ করে দৌড়াতে থাক।”
এভাবে আনারুল, সামসুল এবং আবুল হিন্দু জনতার আক্রমণ থেকে বেঁচে পালাতে পেরেছিলেন, কিন্তু সাদ্দাম হুসাইন সহ অন্য তিনজন ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের হাতে আটকা পড়ে যায়।
পালিয়ে বাঁচা আনারুল তার বড় ভাই মাইনুল হকের কাছে গিয়ে তাদের ছোট ভাই মিরাজুলকে বাঁচাতে বলেন। ঘটনা শুনে মাইনুল তার ১০ বছরের ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেও, মাইনুলকে ঐ তিন জনের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। উপরন্তু তাকে এবং তার ১০ বছরের ছেলেকেও মারধোর করে ঐ হিন্দুরা। তারপর সেখান থেকে কোনরকমে ছুটে মাইনুল পুলিশের কাছে যায় সহায়তার আশায়।
এরই মধ্যে সাদ্দামের বড় ভাই শামসউদ্দিনও স্থানীয় দারুমতল পুলিশ স্টেশনে যায়।
শামসউদ্দিন পুলিশ নিয়ে রাতে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিল, কিন্তু পুলিশও ঐ তিন যুবককে উদ্ধার করতে পারেনি। পরের দিন সকালে অতিরিক্ত পুলিশ পৌছানর পরেই কেবল ১১ টার দিকে আক্রান্তদেরকে হিন্দু গ্রাম থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছিল।
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওগুলিতেও দেখা যায় যে, রাতে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল।
সেখান থেকে উদ্ধারের পর সাদ্দামকে মৃত ঘোষণা করা হয়; আর মিরাজুল এবং বিলালকে গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
তাদের মোটরবাইক দুটি ঐ গ্রামের হিন্দু জনতা পুড়িয়ে ফেলে। হিন্দু জনতা ঘটনাস্থলে সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়া স্থানীয় মিডিয়ার যানবাহনগুলিতেও আক্রমণ করেছিল।
সাদ্দামের অন্য বড় ভাই নাসির মকতুব মিডিয়াকে বলেছেন, “এটি কেবল ঐ ছয়জনকে আক্রমণ করার বিষয় নয়। পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত নয় এমন একজন মাছ বিক্রেতা ভোরের দিকে ঐ রাস্তা দিয়ে মরিগাঁও শহরে যাচ্ছিলেন। আজিম উদ্দিন নামের ঐ মাছ বিক্রেতাকেও যাওয়ার জন্য নির্মমভাবে আক্রমণ করা হয়েছিল।”
নাসির আক্ষেপের স্বরে বলছিলেন যে, সাদ্দাম সাধারণ একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ করতো; কখনও কাজের সন্ধানে মেঘালয়ের কয়লাখনিতে আবার কখনো দক্ষিণের রাজ্যে কাজ করতে যেত সে। এভাবে তার চার সদস্যের পরিবারকে তিনি চালিয়ে নিতেন। কাজ বাদে তিনি তেমন বাইরে বের হতেন না। আর কাজ থেকে ফিরে তার পাঁচ বছরের মেয়ের সাথে সময় দিতেন। সাদ্দামের ৭ বছরের ছেলে এবং কন্যা এখন এতিম হয়ে গেল।
পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দু জনতা নিহত সাদ্দাম এবং আহত অপর দুই জনের শরীরে লাথি মারছিল। মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওগুলোতে এরকম বর্বরোচিত দৃশ্য দেখা যায়।
পুলিশ অবশ্য গণপিটুনিতে জড়িত আট জনকে গ্রেপ্তার করেছিল। তবে গ্রেপ্তারের সময় আনারুল বলেছিলেন, “যারা রাতে আমাদের আক্রমণ করেছিল তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি। আমরা দরিদ্র হওয়ায় আমরা কি ন্যায়বিচারের প্রাপ্য না? আমরা মুসলমান, কেন আমরা কোনও ন্যায়বিচার পাচ্ছি না?
তথ্যসূত্র:
————-
1. Muslim youth lynched to death in Assam’s Morigaon, survivor says familiar men among mob
–https://tinyurl.com/5bsmrdu9