গাজায় দীর্ঘ এক মাস ধরে চলমান আগ্রাসনে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী মানবতার সকল নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। আর তা সত্ত্বেও আমেরিকা ইসরায়েলকে পূর্ণ সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতা দিচ্ছে। যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিন থেকেই তারা নিরঙ্কুশ সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসী ইসরায়েলকে।
তবে, গাজার বাড়িঘর, মসজিদ, স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় বিশ্ব হতবাক হয়ে যাওয়ায় পেছনের মূল ইন্ধনদাতা আমেরিকার অপরাধ যেন কিছুটা আড়ালে পরে যাচ্ছে। গাজায় নির্বিচার গণহত্যা ও আগ্রাসন চালানোর পেছনে অ্যামেরিকার দায় কি কোন অংশে ইসরায়েলের চেয়ে কম! না, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী ইসরায়েলের চেয়ে বেশি।
সন্ত্রাসী ইসরায়েলের সমর্থনে আমেরিকা যুদ্ধের শুরুর দিনেই ভূমধ্য সাগরে তাদের নৌবহর মোতায়েন রেখেছে। আশেপাশের ঘাঁটিগুলোতে প্রস্তুত রেখেছে তাদের যুদ্ধবিমান। আরব দেশগুলোর ওয়াহান আক্রান্ত শাসকরা ফিলিস্তিনের পক্ষে তেমন কোন জোরালো ভূমিকা নিচ্ছে না।অ্যামেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেন আরব নেতাদের সাথে বৈঠকে এটা নিশ্চিত করে এসেছে যে, ফিলিস্তিনি মুসলিমদের পক্ষে আরব নেতাদ্র অবস্থান যেন ঠুনকো বিবৃতি প্রদান আর যৎসামান্য ত্রান প্রেরণের বাইরে না যায়।
পাশাপাশি, ধূর্ত আমেরিকা নিজের ইমেজ ক্লিন রাখতে নিচ্ছে নানান পদক্ষেপ।
পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া এমনকি এই খবরও প্রচার করছে যে, আমেরিকা গাজায় কথিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যপারে ইসরায়েলকে কয়েক দফা সতর্ক করছে। কিন্তু বাস্তবে তার কোন প্রয়োগ কি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আর যদি এমনটা ঘটেও তাহকে, তাহলে বাস্তবতা এই দাঁড়ালো যে, আমেরিকা ইসরায়েলকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যপারে সতর্ক করে আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থও দিচ্ছে।
গত সপ্তাহে আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন জানিয়েছিল যে, ইসরায়েলে ইতিমধ্যে তারা আরও কয়েক ডজন স্পেশাল অপারেশন কমান্ডোকে পাঠানো হয়েছে। তারা গাজায় স্থল অভিযানে অংশ নিবে, তবে তারা সেখানে কোন ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে না, শুধু জিম্মি ইসরায়েলি নাগরিকদের উদ্ধারে কাজ করবে।
পেন্টাগনের ‘গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ না চালানোর’ দাবি প্রসঙ্গে শুরুতেই যে প্রশ্ন এসে যায়, তা হচ্ছে – জিম্মিদের উদ্ধার করতে গেলে তাদেরকে কি ফিলিস্তিনি মুজাহিদ ও নাগরিকদের মুখোমুখি হতে হবে না? সেখানে সংঘর্ষ বেঁধে গেলে কি মার্কিন সেনাদের হাতে কোন ফিলিস্তিনি নিহত হবে না? জিম্মিদেরকে উদ্ধার করার মাধ্যমে তারা কি ইসরায়েলিদেরকে আরও আগ্রাসি হয়ে উঠার সুযোগ করে দিচ্ছে না? আগ্রাসি ইসরায়েলই বাহিনী কি তাদের মাধ্যমে সরাসরি সুবিধা পাচ্ছে না? এভাবে তারা কি ফিলিস্তিনি মুসলিমদের অধিকার রক্ষার বিপক্ষে সরাসরি অবস্থান নিচ্ছে না?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জেনেই আসলে তারা দখলদার ইসরায়েলের পক্ষে মাঠে নেমেছে। তাদের অস্ত্র ব্যবহার করেই সন্ত্রাসী ইসরায়েল গাজায় নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে; যেটি তারা অনেক আগে থেকেই করে আসছে।
মূলত প্রতিদিনই ইসরায়েলকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা।
তাছাড়া, তারা ইসরায়েলের কথিত ‘প্রতিরক্ষার অধিকার’ বিষয়ে অব্যাহতভাবে ওকালতি করেই যাচ্ছে।
ফিলিস্তিন ইস্যুতে এক সাংবাদিক এমনই এক প্রশ্ন করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেলকে। সাংবাদিক বেদান্ত প্যাটেলকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, “আমেরিকা কি ফিলিস্তিন অঞ্চলে জেনেভা কনভেনশনের নীতির স্বীকৃতি দেয়?”
এর উত্তরে মার্কিন প্রশাসন ফিলিস্তিনে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা গণহত্যার ব্যাপারে কোন ব্যাখ্যা না দিয়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষার ব্যাখ্যা শুনিয়ে বলেছে, “আমরা আগেও বলেছি যে, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ইসরায়েল নিজেদের প্রতিরক্ষা করার সকল অধিকার রয়েছে, নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে।”
The US administration refuses to confirm that the Geneva Conventions apply to Palestinians. pic.twitter.com/xrtSNk8nhO
— Nicola Perugini (@PeruginiNic) November 9, 2023
গাজায় সন্ত্রাসী ইসরায়েলি বাহিনীর প্রধান টার্গেট হচ্ছে সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণ। এ লক্ষ্যে গোটা উপত্যকায় অবরোধ আরোপ করেছে সন্ত্রাসী ইসরায়েল। সাধারণ মানুষকে খাবার ও পানি থেকে অনাহারে রাখা হচ্ছে। নারী ও শিশুদের নির্বিচারে গণহত্যা করা হচ্ছে। তাদের হামলায় হাসপাতাল, ধর্মীয় স্থাপনা ও বেসামরিক বাড়িঘর ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তাদের হামলা থেকে বাদ যায়নি ডাক্তার, সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থার কর্মীরাও, যা পশ্চিমাদেরই রচিত জেনেভা কনভেনশনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
আর এসব ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী ইসরায়েলকে একতরফা সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব; বিশেষ করে আমেরিকা। যুদ্ধ শুরুর দিন থেকেই ইসরায়েলের পক্ষে কাজ শুরু করে দেশটি। যত দিন আমেরিকা আছে, তত দিন ইসরায়েলকে একা লড়তে হবে না বলেও ইসরায়েলকে জানিয়েছে আমেরিকা।
উল্লেখ্য যে, জেনেভা কনভেনশন হলো জাতিসংঘ স্বীকৃত যুদ্ধের নিয়ম ও নীতিমালা। এ আইন অনুযায়ী কোনো দেশে যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাত চলাকালীন বেসামরিক জনগণকে খুন, বেসামরিক সম্পত্তি লুণ্ঠন, ধর্ষণ, কারাগারে আটক ব্যক্তিকে বিনাবিচারে হত্যা, নগর, বন্দর ও হাসপাতালে কোন ধরনের সামরিক উস্কানি ছাড়াই আক্রমণ বা ধ্বংস প্রভৃতি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কিন্তু, আমেরিকা বিশ্বের অনেক দেশেই মানবাধিকার, নারী অধিকার ও জেনেভা কনভেনশনের অজুহাতে হস্তক্ষেপ করে থাকে। অথচ তারা নিজেরা কতটুকু আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলে, এবং মানবাধিকার ও নারী অধিকারের নামে তারা বিশ্বে আসলে কি করতে চায়, সেটিও এখন আমাদের নিকট স্পষ্ট থাকা জরুরী।
কেননা, ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম নিকৃষ্ট শাসক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া শেখ হাসিনাকে শাসন ক্ষমতা থেকে হটাতে আমেরিকার নানান পদক্ষেপের কারণে দেশের রাজনীতিতে বর্তমানে জনপ্রিয় অবস্থানে থাকা দলগুলোও আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। আর গণতান্ত্রিক পদ্ধতির অনুসারী এই দলগুলোর উপর ভবিষ্যতে আমেরিকার প্রভাব কি হতে যাচ্ছে, সেবিষয়ে এখন থেকেই তাদেরকে এবং স্বয়ং দেশের জনগণকে সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে হবে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী কোন লিখায় আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্।
তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমেরিকা কথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে বিশ্বজুড়ে আগ্রাসন ও হামলা চালিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। গ্লোবাল রিসার্চ সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে দেখা যায়, গত ৭৩ বছরে বিশ্বব্যাপী ৩৭টি রাষ্ট্র হামলা ও আগ্রাসন চালিয়েছে ৩ কোটিরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে দেশটি, আহত করেছে অন্তত ৩০ কোটি মানুষকে।
মোদ্দা কথা, গাজার মুসলিমদের উপর সাম্প্রতিক চলমান ইতিহাসের অন্যতম বর্বর গণহত্যার পেছনে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েল সরাসরি দায়ী হলেও, তাদের পেছনের মূল ইন্ধনদাতা ও পৃষ্ঠপোষক আমেরিকার অব্যাহত সমর্থন না থাকলে ইসরায়েল তেমন কিছুই করতে পারত না। সুতরাং এই গণহত্যার মূল দায় আমেরিকার; এখানে পর্দার আড়ালের মূল অপরাধী আমেরিকা।
উম্মাহর সিংহপুরুষ উসামা বিন লাদেন রহমাতুল্লাহি আলাইহি অনেক আগেই আমেরিকার মূল অপরাধী হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাদের ঘাড়ে আঘাত করেছিলেন। আর এব্যপারে উম্মাহ্কে সতর্কও করে গিয়েছিলেন তিনি। এখন সেই সতর্কবাণী আমাদের চোখের সামনে দিনকে দিন সুস্পষ্ট হচ্ছে।