কি হচ্ছে মিয়ানমার সীমান্তে!

- আব্দুর রউফ

0
846

বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ সংলগ্ন আরাকান রাজ্য সহ মিয়ানমার-ভারত সীমান্তের রাজ্য এবং অন্যান্য রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে মিয়ানমার জান্তা সরকারি বাহিনী।

বাংলাদেশ লাগোয়া আরাকানে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকার আর্মি এবং রোহিঙ্গা স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র দলগুলোর সাথে জান্তা সামরিক বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ চলছে। বিশেষ করে স্বাধীনতাকামী ও বিদ্রোহী দলগুলো সীমান্তের বিওপিগুলো দখলের উদ্দেশ্যে অভিযান শুরুর পর থেকে যুদ্ধের উত্তাপ বাংলাদেশেও লাগতে শুরু করে।

গত এক সপ্তাহে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামী দলগুলোর পরস্পরের প্রতি ছোড়া গোলা ও গুলি প্রতিনিয়ত এসে পড়ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এপর্যন্ত তিনজন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত এবং আরও অনেক আহত হয়েছেন।

৫ ফেব্রুয়ারি, বান্দরবানের ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলি গ্রামের একটি বাড়িতে মর্টার সেল এসে পরলে নিহত হন স্থানীয় একজন নারী এবং একজন রোহিঙ্গা শ্রমজীবী। স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমারের হেলিকপ্টার এসে গোলা নিক্ষেপ করেছে সেখানে।
এর আগে একই এলাকায় আরও একজন নিহত হয়েছেন। সীমান্তের অপর পার থেকে ছোড়া গুলি এসে লেগেছে চলমান একটি অটোতে, সেখানেও আহত হয়েছেন কয়েকজন।

আগের দিন থেকেই নাইক্ষাংছরির তুম্ব্রু, ঘুমধুম এবং পরে উখিয়ার ঠাইংখালি ও টেকনাফের হোয়াইকং ও অন্যান্য সীমান্তের অপরপাশে বিজিপির সীমান্তচৌকিগুলো দখলে নিতে থাকে বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামীরা। আর কক্সবাজার ও বান্দরবান উভয় জেলার প্রায় সকল সীমান্ত এলাকা দিয়েই মার খেয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্যরা। অস্ত্র জমা নিয়ে তাদেরকে নির্দিষ্ট স্থাপনা ও ক্যাম্পে আশ্রয় দিয়েছে বিজিবি। প্রথমে সাময়িকভাবে ঠাইংখালি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে আগত বিজিপি সদস্যদের।

পরিস্থিতির নাজুকতা আরও বুঝা যায় উখিয়ার বালুখালির একটি ঘটনায়।
উখিয়ার বালুখালির চৌধুরীপাড়ায় নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করেও ৭-৮ জনের একটি সশস্ত্র দলকে নদীর ওপারে মিয়ানমারের ডেকবুনিয়া সীমান্ত ঘাঁটির দিকে গুলি ছুঁড়তে দেখা গেছে। তারা বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে যুদ্ধ চালাচ্ছিল। তবে তারা কি বিদ্রোহী সদস্য ছিলে নাকি সামরিক জান্তার সদস্য, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায় নি ভিডিও দেখে।

ঠাইংখালির সীমান্তের অপর পারে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকেদের এপারে এসে জমায়েত হতে এমনকি টহল দিতেও দেখা গেছে কয়েকটি ভিডিওতে।

তবে ৬ ফেব্রুয়ারি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে যে, শুধু জান্তা সদস্য বা বিজিপি সদস্যই নয়, বরং সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে আহত অনেক বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামী সদস্যও।

রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন আরএসও’র এক আহত সদস্যের অস্ত্র ও মাইন হেফাজতে নিয়ে তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও ফুটেজও দেখা গেছে একটি সংবাদমাধ্যমে। দেখা গেছে বিদ্রোহী বা স্বাধীনতাকামীদেরকে গুলি করতে করতে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করার দৃশ্যও। অনেকেই আবার অস্ত্র ফেলে দিয়ে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাদের অস্ত্রগুলো স্থানীয়রা উদ্ধার করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করেছে।

একজন আরএসও সদস্যের বরাতে কয়েকটি সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে যে, সামরিক জান্তার সাথে বিদ্রোহী ও স্বাধীনতাকামীরা একজোট হয়ে লড়াই করছিল। তাদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল এই মর্মে যে, আরাকান আর্মি একটি নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত দখল করবে এবং আরএসও দখল করবে বাকি এলাকার বিওপিগুলো। কিন্তু, তার মতে, আরাকান আর্মি সেই সমঝোতা ভঙ্গ করায় তাদের পরস্পরের মঝেও সংঘর্ষ শুরু হয়। ফলে বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে এখন চলছে ত্রিমুখী সংঘর্ষ।

আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের একটি দলকেও দেখা গেছে তারা একটি বিওপি দখল করে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র জব্দ করেছে। ভিডিওতে তাদেরকে রোহিঙ্গাদের প্রতি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানাতেও দেখা গেছে। পরে জানা যায়, ভিডিওতে রোহিঙ্গাদের যুদ্ধের আহ্বান জানানো ব্যক্তি নবী হোসেন বা নবী মাঝি, যিনি একসময় আরসার সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন পরবর্তীতে তিনি রোহিঙ্গা আরাকান আর্মি নামের আলাদা দল গঠন করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান বলে দাবী করেছে ভিডিও প্রচারকারী সংবাদমাধ্যমটি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অভিমুখে আবারো রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। কেননা ইতিপূর্বে দেখা গেছে, আরাকান আর্মি মৌখিকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে সমর্থন ও রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক বললেও, তারাও বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে সামরিক জান্তার মতোই নিষ্ঠুর আচরণ করে আসছে।

ইতিমধ্যে অনেক রোহিঙ্গা গোপনে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে যে, সীমান্তে অনুপ্রবেশের জন্য জড়ো হয়েছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।

বাংলাদেশের সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বললেও, সীমান্ত এলাকায় মানুষকে ইতিমধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও সতর্ক করছেন যে, বাংলাদেশ অতি দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে বড় কোন যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে, যা বাংলাদেশকে ভোগাবে।

উল্লেখ্য, ৭ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৩২৮ জন বিজিপি ও স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা সীমান্ত পেড়িয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সামরিক জান্তার অনেক সদস্য আবার পরিবার সহ পালিয়ে এসেছেন। তাদের সবাইকে সাময়িকভাবে ঘুমধুম সীমান্তের কলেজ ভবনে রাখা হয়েছে এবং পরে বিজিবি ক্যাম্পে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

যারা কয়েক বছর আগে অসহায় রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নির্যাতন ও গণহত্যা চালিয়ে তাদেরকে অন্যায়ভাবে বিতাড়িত করেছিল, তারাও আজ প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছে।

সবশেষ খবরে জানা গেছে, বান্দরবান ও কক্সবাজার অক্ষ অতিক্রম করে সীমান্তের ওপারের যুদ্ধ ক্রমেই দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হচ্ছে।


তথ্যসূত্র:
১। যুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশে | Bandarban | Ghumdhum | Tumbru |
http://tinyurl.com/4azfcaw8
২। মিয়ানমারে সেনা-বিদ্রোহী তুমুল গোলাগুলি; বাংলাদেশে নিহত ২ | Bandarban Border |
http://tinyurl.com/yr8pwbz3
৩। বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় সীমান্তে হাজারও রোহিঙ্গা! | Myanmar |
http://tinyurl.com/vfkd7urx
৪। ফেলে যাওয়া ভারী অস্ত্র, গুলি-বোমা উদ্ধার করছে স্থানীয়রা | Myanmar border
http://tinyurl.com/2vvntw43
৫। গু লি ছুড়তে ছুড়তে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ল মিয়ানমারের অ স্ত্র ধা রী রা | Myanmar Update
http://tinyurl.com/3bf33cht
৬। অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরা মিয়ানমারের বিদ্রোহী! (RSO) | Myanmar | Insurgent |
http://tinyurl.com/29z2jatm
৭। বাংলাদেশে দিকে আসার চেষ্টা আরএসও এবং আরাকান আর্মিরা | Arakan Army | RSO | Mayanmar News |
http://tinyurl.com/5b9pm5mz
৮। ‘একটা স্বাধীন দেশের ভেতর এসে যুদ্ধ করতেছে, দেখার কেউ নাই’ | Myanmar Crisis |
http://tinyurl.com/2xn3ftst
৯। টেকনাফের দিকে এগোচ্ছে আরাকান আর্মি | Arakan Army | Border Situation | Mayanmar |
http://tinyurl.com/hahw5y2m
১০। আরো অস্থির হচ্ছে ঘুমধুম, বাড়িতে পড়ছে মর্টারশেল | Myanmar-Bangladesh Border | Bandarban |
http://tinyurl.com/v872jr36
১১। সামরিক জান্তার সংঘর্ষ ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছে দক্ষিণের দিকে | Myanmar Crisis | Janta |
http://tinyurl.com/bdh9jkxu
১২। রাখাইন রাজ্যের আরো একটি শহরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
http://tinyurl.com/nhjf7n8p

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএসএফের বাধায় বন্ধ বেনাপোল ট্রাক টার্মিনালের নির্মাণকাজ
পরবর্তী নিবন্ধমাদকের ভয়াবহতা মোকাবেলায় তালিবান সরকারের উপযুক্ত কৌশল