দারসে রমাদান।। দারস-৬।। পাপের পর নেকি করো ।।

0
187

আমাদের প্রতি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নসীহত হচ্ছে:
“اتَّقِ اللهَ حيثُما كنتَ ، وأتبِعِ السَّيِّئةَ الحسَنةَ تَمْحُهَا ، وخالِقِ النَّاسَ بخُلُقٍ حَسنٍ .”
অর্থ: যেখানেই থাকো আল্লহকে ভয় করো, পাপের পর নেকি করো, তা পাপকে মিটিয়ে দেবে এবং মানুষের সাথে সদাচরণ করো। [তিরমিযী, হা. ন. ১৯৮৭]

এই হাদীসের “পাপের পর নেকি করো” অংশটুকু আজকের মজলিসের বিষয়বস্তু। আপনার জীবনের প্রতীক, কর্মপন্থা, পথ-পদ্ধতি, অভ্যাস এমন হওয়া উচিত যে, যখনই আপনি কোনো গুনাহ ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হবেন, তখনই অবিলম্বে ইবাদত-অনুগত্যের কোনো কাজও করে নিবেন।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন:
وَأَقِمِ الصَّلاَةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفاً مِّنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّـيِّئَاتِ
অর্থ: দিনের দুই প্রান্তভাগে ও রাতের কিছু অংশে নামায কায়েম করুন। নিশ্চয়ই ভালো কাজ মন্দ কাজকে মিটিয়ে দেয়। [সূরা হুদ, /১১৪]
এটি আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহ যে, পুণ্যরাজি পাপরাশিকে মিটিয়ে দেয়।
এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বেশকিছু পন্থা ও উপায় শিখিয়েছেন, যেগুলো আমরা পাপ কাজ করে ফেললে গ্রহণ করতে পারব।

কিছু মানুষের দিকে লক্ষ করলে শয়তানের ষড়যন্ত্রের বাস্তবতা বুঝতে পারবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولاً
অর্থ: শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। [সূরা ফুরকান, /২৯]
خذولاً এর অর্থ হচ্ছে— শয়তান মানুষকে ইবাদত-অনুগত্য ও তওবার পথ থেকে সরিয়ে ফেলে। এটাই শয়তানের লক্ষ্য। আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمْ عَدُوٌّ فَاتَّخِذُوهُ عَدُوّاً
অর্থ: নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের শত্রু, সুতরাং তাকে শত্রু হিসেবেই গ্রহণ কর।

শত্রু হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাকে বন্ধু, প্রিয়জন, সহচর ও বিনোদনসঙ্গী না বানিয়ে শত্রু বানাবেন। মানুষ করে উল্টোটা; শয়তানকে নিত্যসঙ্গী বানায়। শয়তানের কোনো আবেদন প্রত্যাখ্যান করে না। শয়তানকে বলে, আমি তোমার কথা শুনলাম ও অনুগত্য করলাম। শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কুমন্ত্রণা আসার সাথে সাথে তা কার্যকর করে। তার এসব কর্মকাণ্ড-ই শয়তানের সামনে তার অসহায়ত্বের প্রমাণ।  অথচ আল্লাহ তাআলা বলেন:
إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفاً
অর্থ: শয়তানের ধোঁকা নিতান্তই দুর্বল।

শয়তানের ধোঁকা, কূটকৌশল খুবই দুর্বল। কিন্তু কিছু মানুষ গুনাহে লিপ্ত হলে লাগাতার সেই গুনাহ করতেই থাকে। গুনাহ করেছেন বুঝলাম; এরপর নেকিও করুন। একথা বললে কেউ কেউ বলবে, মাত্রই গুনাহের কাজ করেছি, এখন কীভাবে নেককাজ করব? গুনাহ করেছেন বুঝলাম; এখন নেকি করতে বাধা কী? আপনি এই মানুষটিকে দেখবেন যে, সে একটি গুনাহের কাজ করার কারণে নিজেকে ইবাদত-আনুগত্য থেকে বঞ্চিত করছে। এটিই হচ্ছে মানুষকে শয়তানের ধোঁকা দেওয়ার কৌশল।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে নসীহত করেছেন,
عن عثمان بن عفان رضي الله عنه- :” مَن تَوَضَّأَ نَحْوَ وُضُوئِي هذا، ثم قام وصلى ركعتين لا يُحَدِّثُ فِيهِما نَفْسَهُ غُفر له ما تقدّم من ذنبه”, أو “غَفَرَ اللَّهُ له ما تَقَدَّمَ مِن ذَنْبِهِ. ”
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার এই ওযুর ন্যায় ওযু করবে, অতঃপর দাঁড়িয়ে খুশু-খুযুর সাথে দুই রাকাত নামায পড়বে, তার পিছনের সকল গুনাহ মাফ করা হবে। অথবা তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তার পূর্বেকার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং, ১৫৯)

কেউ যদি নজরের খেয়ানত, হারাম কথাবার্তা, মিথ্যা-গীবত বা অন্যকোনো গুনাহ করে; অতঃপর কালবিলম্ব না করে ওযু করে দুই রাকাত নামায পড়ে। আপনি বলতে পারেন বা শয়তান ওয়াসওয়াসা দিতে পারে যে, নামায পড়ে পরবর্তীতে পুনরায় সেই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি বলব, আপনি এখনই তওবা করুন। এমনও হতে পারে এরপর আপনার মৃত্যু এসে যাবে। তখন তো আপনার মৃত্যু তওবার পরপরই হবে। আল্লাহর সাথে তওবাকারী অবস্থায় সাক্ষাৎ করবেন। গাড়ি দুর্ঘটনায় ক্ষণিকের মধ্যে আপনার মৃত্যু হতে পারে।

ইবলিস সর্বশক্তি ব্যয় করে মানুষকে ইবাদত-আনুগত্য থেকে সরিয়ে রাখতে ও গুনাহে লিপ্ত রাখতে অবিরাম চেষ্টা করে যায়। কিছুলোক নামায পড়ে না। জিজ্ঞাসা করলে বলে, আমি যিনা করেছি; কীভাবে, কোন মুখ নিয়ে নামাযে দাঁড়াব? অধিকাংশ যুবকদের এই সমস্যা। বলে, আমি তো যিনা করেছি, এখন কীভাবে নামায পড়ব? যিনা করেছ মানলাম। একলোক যিনাও করেছে নামাযও পড়েছে, আরেক লোক যিনা করেছে কিন্তু নামায পড়েনি। এই অবস্থাতেই উভয়ের মৃত্যু হয়েছে। এদের মাঝে কে উত্তম? নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে বেনামাযী যিনাকারী অপেক্ষা নামাযী যিনাকারী উত্তম। বেনামাযীর ব্যাপারে কোনো কোনো আলেম বলেন, সে কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।

এটি শয়তানকে পরাভূত করা, তার ধোঁকাবাজি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মহান এক কৌশল। যখনই কোনো গুনাহ হয়ে যাবে, তৎক্ষণাৎ কিছু ইবাদত-আনুগত্য করে নিন। আপনি একশবার سبحان الله وبحمده পড়তে পারেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
” من قال : سبحان اللهِ وبحمدِه مائةَ مرةٍ غُفرَتْ له ذنوبُه وإنْ كانتْ مثلَ زبَدِ البحرِ .”
অর্থ: যে ব্যক্তি একশবার سبحان الله وبحمده পড়বে তার গুনাহ সমুদ্রের ফেনাসম হলেও ক্ষমা করা হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং, ৬৪০৫)

আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কেউ সমুদ্রের ফেনার পরিমাপ করতে সক্ষম না। গুনাহ হয়ে গেলে একশবার سبحان الله وبحمده অথবা أستغفر الله পড়ে নিন। সামান্য হলেও সাদাকা করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“إنّ الصدقَةَ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ”
অর্থ: সাদাকা আল্লাহ তাআলার রাগ নিভিয়ে দেয়। (তিরমিজি, হা.ন. ৬৬৪)

দুই রাকাত নামায পড়ুন, কয়েক পৃষ্ঠা কুরআন তিলাওয়াত করুন। কুরআনের প্রতি হরফ তিলাওয়াতের বিনিময়ে কমপক্ষে দশ নেকি দান করা হয়। প্রতি পৃষ্ঠায় বা রুকুতে একশ থেকে দুইশ হরফ আছে। দুইশ হরফে দুই হাজার নেকি। যদি আন্তরিকভাবে আল্লাহকে পেতে চান, তাহলে গুনাহ হয়ে গেলে তৎক্ষণাৎ কোনো না কোনো নেক আমল করে নিন।

কেউ এমনও বলে যে, আমি খুব দুর্বল। আপনি পাপের সামনে দুর্বল; নেকির সামনে সবল হচ্ছেন না কেন? নেকির সামনেও দুর্বল? এটা ভুল। আমি সবদিকেই দুর্বল, আমি পারছি না, আমার নফসকে সবল করতে পারছি না, আমার সাহস হারিয়ে ফেলেছি, আমার মাঝে দৃঢ়তা নেই, পাপের কাজে সবর করতে পারছি না, শেষমেশ গুনাহ করেই ফেলছি— এসব শয়তানের ধোঁকা ও ভুল কথা। আপনি কেন শক্তিশালী হচ্ছেন না? রাসূলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেননি,
المُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ،
অর্থ: আল্লাহর নিকট দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন অধিক প্রিয়। (সহীহ মুসলিম, হা. ন. ২৬৬৪)

আপনার জীবনের প্রতীক, কর্মপন্থা, পথ-পদ্ধতি, অভ্যাস এমন হওয়া উচিত যে, যখনই আপনি কোনো গুনাহ ও অবাধ্যতায় লিপ্ত হবেন, তখনই অবিলম্বে কিছু ইবাদত-অনুগত্যের আমল করে নিবেন। শুধু একটি নয়; একাধিক নেক আমল করুন। আল্লাহ তাআলা রহম-করম করে আপনার পাপমোচন করে আপনাকে ক্ষমা করবেন এবং নতুন জীবন দান করবেন ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে এই পদ্ধতি গ্রহণ করতে দেখে আনুগত্য ও তাওবার তাওফীক দান করবেন।

আমি মুনাফিক। যিনা, চুরি, মদ্যপান ইত্যাদি মন্দকাজের পর কীভাবে মসজিদে যাব— এমন চিন্তা শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। সে বলবে, এটা নিফাকি। মাত্রই তুই গুনাহ করেছিস! এখন আবার নেক আমল করবি— এটা নিফাকি। নিঃসন্দেহে এমন চিন্তা শয়তানের কুমন্ত্রণা। সে চায় যেকোনো পন্থায়, যেকোনো উপায়ে আপনাকে নেক আমল থেকে মাহরুম করতে। তার লক্ষ্যই আপনাকে আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য থেকে দূরে সরানো। সাবধান! শয়তানের এই কুমন্ত্রণা, ধোঁকাবাজির জালে ফেঁসে যাওয়া থেকে পূর্ণ সাবধান! নফসকে বুঝিয়ে এভাবে গঠন করুন যে, যখনই আমি মানসিকভাবে দুর্বলতা-অবসন্নতা, নাকস-শক্তিস্বল্পতা অনুভব করব, তখনই আল্লাহ তাআলার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করব। এটি প্রকৃত মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট ও গুণ।
আল্লাহ জাল্লা ওয়াআলা বলেন:
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُواْ فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُواْ أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُواْ اللّهَ فَاسْتَغْفَرُواْ لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلاَّ اللّهُ وَلَمْ يُصِرُّواْ عَلَى مَا فَعَلُواْ وَهُمْ يَعْلَمُونَ,
অর্থ: (তারাই প্রকৃত মুত্তাকী) যারা অশ্লীল কাজ বা নিজের উপর জুলুম করে যখন আল্লাহর কথা স্মরণ করে, তৎক্ষণাৎ নিজ গুনাহের কারণে ইস্তিগফার করে। আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ গুনাহ ক্ষমাকারী নেই। তারা স্বজ্ঞানে সেই গুনাহে স্থির থাকে না। [সুরা আলে ইমরান]

মুমিন কখনও গুনাহে স্থির থাকতে পারে না। মানুষ যখন কোনো গুনাহ করে তৎক্ষণাৎ তাওবা করে তখন পুরোটাই কল্যাণকর হয়ে যায়। পক্ষান্তরে এর পুরোটাই অকল্যাণকর হবে, যখন গুনাহ করে এবং বারবার করতে থাকে। প্রকাশ্যে গুনাহ করে, গুনাহে স্থির থাকে। এটা মুমিনের শান-মান নয়। সে স্থির হয়ে গুনাহ করতে পারে না; বরং তাওবা করে ফিরে আসে। যদি একমাস বা ছয়মাস পর বলেন, আমি পুনরায় সে গুনাহে লিপ্ত হয়েছি। আমি বলব, তৎক্ষণাৎ তাওবা করুন। ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আপনাকে তাওবা নসীব করবেন, উক্ত গুনাহের প্রতি অন্তরে ঘৃণা সৃষ্টি করে দেবেন।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে গুনাহ মুক্ত জীবন দান করুন এবং তওবা করার তৌফিক দান করুন। আমীন।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধপাকিস্তানের বিমান হামলায় আফগানিস্তানে নারী-শিশুসহ নিহত ৮
পরবর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনের জিহাদ || আপডেট – ১৯ মার্চ, ২০২৪