সুপ্রিয় ভাই, এমন একটি রোগ আছে, যেটি নেককার, সংস্কারক, নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকলের মাঝে মহামারির রূপ ধারণ করেছে। এই রোগটি কবিরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। রোগটির নাম হাসাদ-হিংসা।
হাসাদ বা হিংসা (الحسد) অর্থ কি?
ইমাম নববী রহ. “রিয়াজুস সালেহিন” কিতাবে বলেন,
هو تمني زوال النعمة, أنك تتمنى أن تزول النعمة عن أخيك المسلم سواء كانت نعمة دينية أو نعمة دنيوية.
অর্থ: হাসাদ হচ্ছে নেয়ামত ও অনুগ্রহ দূর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আপনার অন্তরে মুসলিম ভাইয়ের নেয়ামত দূর হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করা। সেই নেয়ামত দ্বীনী হোক বা দুনিয়াবি।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইহুদিদের একটি গুণ উল্লেখ করেছেন, “তারা মানুষের প্রতি আল্লাহ-প্রদত্ত নেয়ামত-অনুগ্রহের ওপর হিংসা করে”। এই গুণটি ইহুদীদের; তাই আমাদের এবিষয়ে সাবধান হতে হবে।
সর্বপ্রথম আল্লাহর সাথে যে অবাধ্যতা করা হয় তার নাম হিংসা, এটা হযরত আদম আলাইহিস সালামের প্রতি ইবলিস করেছিল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নসীহত করেছেন:
“لا تحاسدوا ولا تباغضوا ولا تقاطعوا ولا تدابروا وكونوا عباد الله إخوانًا”.
অর্থ: তোমরা হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ও একে অপরের ছিদ্রান্বেষণ থেকে বিরত হও। আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে যাও”। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং, ৬০৬৫)
আল্লাহ তাআলা কুরআনে মুমিনদের গুণ বর্ণনা করেছেন:
وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلّاً لِّلَّذِينَ آمَنُوا
অর্থ: আমাদের অন্তরে মুমিনদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করবেন না”। (সূরা আল-হাশর, আয়াত, ১০)
হিংসার অনেক ক্ষতি রয়েছে। প্রথম ক্ষতি হচ্ছে, হিংসা মূলত আল্লাহর ফায়সালার ওপর আপত্তি করার শামিল। জানেন কি, হিংসুটে আল্লাহর ফায়সালার ওপর আপত্তি করে! সে আল্লাহর ফায়সালার প্রতি কুধারণা রাখে। যেন সে মনে মনে বলছে; হে আল্লাহ, আপনি এই নেয়ামত আমাকে না দিয়ে অমুককে কীভাবে দান করলেন? কীভাবে আমাকে না দিয়ে তাকে দিলেন? সে আল্লাহর আদল-ইনসাফ, কাযা-ফায়সালার ওপর কুধারণা রাখে। অথচ আল্লাহ তাআলা সকল ইনসাফকারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইনসাফকারী, সকল বিচারকদের শ্রেষ্ঠ বিচারক, শ্রেষ্ঠ দয়াশীল। তিনি সকল বস্তুকে যথাস্থানে রাখেন। আল্লাহ তাআলার একটি নাম (الحكيم)। আল-হাকীম বলা হয় যিনি সকল বস্তুকে উপযুক্ত স্থানে রাখেন।
হিংসা-হাসাদের আরেকটি ক্ষতি হচ্ছে, হিংসুটে সর্বদা দুশ্চিন্তা-পেরেশানী ও ভারাক্রান্ত থাকে। যখনই সে দেখে কোনো ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনী-দুনিয়াবী নেয়ামত দিয়েছেন, তখনই মানসিকভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে যায়। কারো কারো হিংসা তো চেহারায় প্রস্ফুটিত হতেও দেখা যায়। যেমন, তার কাছে খবর এলো, অমুক ব্যক্তি প্রচুর ধন-সম্পদ পেয়েছে, অমুক একটি গাড়ি হাদিয়া পেয়েছে, অমুক নেককার ও সুন্দরী নারীকে বিবাহ করেছে। সংবাদ আসামাত্র হিংসুটের চেহারা ফ্যাকাশে হতে দেখবেন। তদ্রুপ, কারো থেকে আল্লাহ তাআলা নেয়ামত উঠিয়ে নিলে তার চেহারার রঙ পরিবর্তন হতে দেখবেন। সুবহানাল্লাহ! হিংসুটে আপন ভাইয়ের খুশিতে খুশি হয় না, তার দুঃখে দুঃখিত হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
“لا يُؤْمِنُ أحدُكُم حتى يُحِبَّ لِأَخِيهِ ما يُحِبُّ لنفسِهِ ”
অর্থ: তোমাদের কেউ ততক্ষণ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ করে যা সে নিজের জন্য পছন্দ করে। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং, ১৩)
আপনার কাছে ইলম, ফিকাহ, ইবাদত, ইতাআত, কুরআনের হিফজ, কিয়ামুল লাইল, সিয়ামুন্নাহার-এইসব গুণ থাকা সত্ত্বেও; আপনি যদি অপর ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ না করেন যা নিজের জন্য পছন্দ করেন বা অন্যের কল্যাণ-কামনা না করেন, তাহলে বলব; আপনি এখনও পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারেননি। এখনও আপনি অপূর্ণ মুমিন। আমি রাতে নামায পড়ি, দিনে রোযা রাখি, কুরআন হিফজ করেছি, হাদীস মুখস্থ করেছি, আমি ইমাম-খতিব, আমি দ্বীনদারীতে প্রসিদ্ধ এভাবে আপনার যত নেক আমলই থাকুক না কেন; যতক্ষণ অপর ভাইয়ের জন্য তা-ই পছন্দ না করবেন যা নিজের জন্য করেন, অপর ভাইয়ের জন্য তা-ই অপছন্দ না করবেন যা নিজের জন্য অপছন্দ করেন, আমি বলব; শরীয়তের মানদণ্ডে এখনও আপনি অপূর্ণ মুমিন।
প্রিয় ভাই, এজন্য সবসময় নফসের সাথে আপনাকে মুজাহাদা ও সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। উদাহরণত, যখনই আপনার নফসে অন্য ভাইয়ের আল্লাহপ্রদত্ত দ্বীনী-দুনিয়াবী নেয়ামত পেতে দেখলে খারাপ লাগবে এবং সেই নেয়ামত তার থেকে দূর হওয়ার মনোবাঞ্ছা থাকবে, তখন আপনার করণীয় কী? আপনার উচিত নফসের সাথে মুজাহাদা করা, আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করা; হে আল্লাহ, তাকে নেককাজের তাওফীক দিন, তার রিজিকে বরকত দিন। আপনি শুনেছেন, আপনার অমুক মুসলিম ভাইকে আল্লাহ তাআলা একটি ঘর দিয়েছেন, একজন সুন্দরী স্ত্রী দিয়েছেন, মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি দিয়েছেন, তার অঢেল সম্পদ হাসিল হয়েছে, অমুক কুরআন হিফজ করেছে; আপনি দোয়া করুন; হে আল্লাহ তাকে আরও দিন, তার রিজিকে আরও বরকত দিন। তখন আপনার ও আপনার নফসে আম্মারা এবং শয়তানের মাঝে একটি রণক্ষেত্র তৈরি হয়ে যাবে। আপনি আল্লাহকে দেখাবেন; ইয়া আল্লাহ, আমি নফসের সাথে মুজাহাদা করেছি যেন আমার অন্তর সুস্থ হয়ে ওঠে।
সুবহানাল্লাহ! হে দ্বীনী ভাই, প্রত্যেকটি মানুষের অন্তর দুনিয়ার সাথে লেগে থাকে। এই মূল্যবান মূলনীতির দিকে একটু দৃষ্টিপাত করুন, “প্রত্যেকটি মানুষের অন্তর দুনিয়ার সাথে লেগে থাকে”। সুবহানাল্লাহ! মানুষকে দুনিয়ার জন্য চিন্তা-পেরেশানী করতে দেখবেন।
আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার পরোয়া করে না, যিনি দুনিয়াত্যাগী; ইবনুল কাইয়ুম রহিমাহুল্লাহ বলেন, الزهد راحة القلب والبدن দুনিয়াত্যাগ অন্তর ও দেহের প্রশান্তির কারণ। যে ব্যক্তির অন্তর আখেরাতের সাথে লেগে থাকে, সে এসব দুনিয়াবি তুচ্ছ ধন-দৌলতের দিকে তাকায় না। সে মানুষের জন্য বরকত, ব্যবসা-বাণিজ্যের বরকত, শাহাদাতের তাওফীক, দ্বীনী কাজের তাওফীকের দোয়া করে। আপনি দোয়া করুন, নফসের সাথে মুজাহাদা করুন। মুজাহাদা চালিয়ে যান যেন আল্লাহকে দেখাতে পারেন যে, হে আল্লাহ, আমি নফসের সাথে মুজাহাদা করেছি।
সুহৃদ ভাইয়েরা, হিংসার রোগ খুব ব্যাপক। ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন,
ما خلا جسدٌ من حسد ولكن الكريم يخفيه واللئيم يُبديه.
“কোনো দেহ হিংসা থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু ভালো লোক তা গোপন রাখে আর মন্দ লোক তা প্রকাশ করে”।
হিংসার অনেক ধরণ রয়েছে। পূর্বে বলেছি হিংসার রোগ নারীদের মাঝে সবচে বেশি। যেমন, এক নারী অন্য নারীর ঘরে দেখা করতে গেল। গিয়ে দেখল, মাশাআল্লাহ! তার ঘর তো অনেক সুন্দর এবং নতুন নতুন আসবাবে ভরপুর। কিছুদিন পর শুনতে পেল, সেই ঘরটি পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে। এটি শুনে সেই নারীর অন্তর পুলকিত হয়ে উঠেছে। এটাও হিংসা। আপনার মুসলিম ভাইয়ের ব্যাপারে কোনো বিপদ-মুসিবত, অসুস্থতা বা অভাব-অনটনের সংবাদ শুনে আপনার অন্তরে যদি ভালো লাগে তাহলে আমি বলব, এটাও হিংসা। কোনো মুসলিম ভাইয়ের আল্লাহর নেয়ামতরাজি লাভ করা, ভালো কিছুর তাওফীকপ্রাপ্ত হওয়া, দ্বীনী-দুনিয়াবি কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার খবর শুনে আপনার মন যদি দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে তাহলে আমি বলব, এটাও একপ্রকার হিংসা।
সুতরাং, নিজের অন্তরের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া ও মুহাসাবা করা আমাদের প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক। ভালোকরে দেখুন, আপনার অন্তরে হিংসা আছে কি না। আল্লাহর কাছে সর্বদা দোয়া করুন,
اللهم نقِّ قلبي من الأمراض, نقِّ قلبي من الحسد من الضغينة من الكراهية.
অর্থ: হে আল্লাহ, আমার অন্তরের যাবতীয় রোগ পরিষ্কার করে দিন। অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে মুক্ত করে দিন।
আরও একটি উদাহরণ দেখুন, এক মহিলার স্বীয় স্বামীর সাথে ঝগড়া লেগেই থাকে। সে যখন শুনে যে, মাশাআল্লাহ! অমুক নারী দাম্পত্য-জীবনে খুবই ভাগ্যবতী। সে তার স্বামীকে পেয়ে খুবই সুখী। সুবহানাল্লাহ! দেখবেন এই নারী ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। হঠাৎ একদিন খবর আসলো, সেই ভাগ্যবতী নারীর নিজ স্বামীর সাথে ঝগড়া সৃষ্টি হয়েছে। খবরটি শুনে এই নারী আনন্দে আটখানা হয়ে গেছে। খুশিতে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তার মনের আনন্দ চেহারায় উথলে উঠছে।
তাই আমাদের সাবধান হতে হবে, সূক্ষ্মভাবে অন্তরকে যাচাই করতে হবে। পূর্বে বলেছি, হিংসা কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এটা আল্লাহ তাআলার ফায়সালা ও কুদরতের প্রতি আপত্তির শামিল।
বলতে পারেন, কীভাবে অন্তরকে হিংসা থেকে পবিত্র করব? বলব, মুজাহাদার মাধ্যমে। যার প্রতি হিংসা সৃষ্টি হবে তার জন্য সবসময় নেকদোয়া করুন। আরও দোয়া করুন, আল্লাহ তাআলা যেন আপনার অন্তর হিংসা থেকে পরিষ্কার করে দেন। আমীন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম