আমাদের প্রতি রাসূলে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি উপদেশ হলো, সালামের প্রসার ঘটানো। সালাম মুসলিমদের পারস্পরিক মুহাব্বত-ভালোবাসার প্রতীক। বিভক্তি ও পরাধীনতার এই যুগে আমরা মুসলিমদের পারস্পরিক একতা, ভালোবাসা ও হৃদ্যতার মুহতাজ ও মুখাপেক্ষী। সহীহ মুসলিমের এক হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“لا تدخلوا الجنَّةَ حتَّى تؤمنوا ولا تؤمنوا حتَّى تحابُّوا، أولا أدلُّكم علَى شيءٍ إذا فعلتُموهُ تحاببتُم، أفشوا السَّلامَ بينَكم”
অর্থ: মুমিন না হয়ে জান্নাতে যেতে পারবে না। (মুমিনদের) ভালোবাসা ছাড়া (প্রকৃত) মুমিন হতে পারবে না। আমি কি তোমাদের এমন একটি বিষয়ের কথা বলে দেব না, যা করলে তোমাদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পরের মাঝে সালামের প্রসার করো”।
আমাদের আজকের মজলিসে সালামের প্রচার-প্রসার নিয়ে কথা বলব। সহীহ হদিসে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইসলামের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়; ইসলামের কোন কাজটি সবচে কল্যাণকর? উত্তরে তিনি বলেন:
“تُطْعِمُ الطَّعَامَ وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ”
“খাবার খাওয়ানো, পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দেওয়া”।
প্রিয় ভাই, বর্তমানে আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা কেবল পরিচিতদের সালাম দিই। এক ডাক্তার শুধু অপর ডাক্তারকে সালাম দেয়। সবাই কেবল সমস্তরের লোকদেরকে সালাম দেয়। কোনো ফকির, মিসকীন, ফেরিওয়ালাকে সালাম দেয় না। জিজ্ঞাসা করলে বলবে, আমি সার্টিফিকেটধারী ডাক্তার। আমি কীভাবে তাদের সালাম দেব? তাদের উচিত আমাকে সালাম দেওয়া। কোনো গভর্নর বা মন্ত্রী কেবল তার সমস্তরের বা স্বদেশের লোকদের সালাম দেয়। যদি কোনো শ্রমিককে দেখে— অত্যন্ত আফসোসের বিষয়, যদি আল্লাহর ঘরেও কোনো নামাযী শ্রমিকের সাথে দেখা হয়— কেউ তার প্রতি ভ্রুক্ষেপও করে না। কেউ তাকে সালাম দেয় না। আর যদি সেই ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাশীল পর্যায়ের লোক হয়, রাষ্ট্রীয় পোশাক পরে, তাহলে সকলে তাকে সালাম করে। এটা সামাজিক ব্যাধি; আমাদের তা পরিহার করা এবং তা থেকে দূরে থাকা উচিত। পরিচিত ছাড়া অন্য কাউকে সালাম না দেওয়া কখনো কখনো অহমিকা, আত্মম্ভরিতা ও অন্যদের তুচ্ছজ্ঞান করার কারণে হয়ে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
“بحَسْبِ امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أنْ يَحْقِرَ أخاهُ المُسْلِمَ.”
“মানুষ নিজের ভেতরের মন্দত্বের পরিমাণ অনুযায়ী মুসলিম ভাইকে তুচ্ছজ্ঞান করে”। (সহীহ বুখারী, হাদিস নং- ৬০৬৪)
কিছুলোক আছে তারা যদি মসজিদেও এমন কাউকে দেখে যার পোশাক-পরিচ্ছদ, গঠন-অবয়ব তাকে আকৃষ্ট করে না, তাহলে তাকে সালাম দেয় না। নিজের ডানপাশের পরিচিত বা স্বদেশী লোককে সালাম দিচ্ছে, কিন্তু; বামপাশের অপরিচিত অনাড়ম্বর লোকটিকে সালাম দিচ্ছে না। এটা সামাজিক ব্যাধি।
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসা ছিলেন। একলোক এসে “السلام عليكم” বলে বসে পড়ল। তিনি বললেন, সে দশ নেকি পেয়েছে। অতঃপর আরেক লোক এসে “السلام عليكم ورحمة الله” বলে সালাম দিল। তিনি বললেন, সে বিশ নেকি পেয়েছে। এরপর তৃতীয় ব্যক্তি এসে “السلام عليكم ورحمة الله وبركاته” বলে সালাম দিল। তিনি বললেন, সে ত্রিশ নেকি পেয়েছে। (তিরমিজি, হাদিস নং- ২৬৮৯)
তাই আমাদের উচিত পূর্ণাঙ্গ সালাম দেওয়া। কিছুলোক মজলিসে উপস্থিত হয়ে বা মোবাইলে শুধু “السلام عليكم” বলে। আল্লাহ আপনাকে জাযা দান করুন। হে ভাই, আপনি “السلام عليكم ورحمة الله وبركاته” বলে পূর্ণ সালাম দিন। এতে ত্রিশ নেকি পাবেন। এক নেকি দশ নেকির সমান। তাহলে কমপক্ষে তিনশত নেকি হবে। আল্লাহ তাআলা চাইলে আরও বাড়িয়ে দেবেন। নেকি থেকে নিজেকে মাহরুম করবেন না। পূর্ণ সালাম দিন। বারবার পূর্ণ সালাম উচ্চারণ করে যবান প্রস্তুত করুন।
সুন্নত হচ্ছে, মজলিস শেষ হলে “السلام عليكم ورحمة الله وبركاته” বলে সালাম দেওয়া। যেমন, এক হাদীসে এসেছে,
“ليست الأولى بأحق من الأخرى ”
অর্থ: (মজলিসের) প্রথম সালাম (মজলিসের) শেষ সালাম অপেক্ষা উত্তম নয়। (তিরমিজি, হাদিস নং- ২৭০৬) কিছুলোক মজলিস শেষে “في أمان الله”, “مع السلامة” এজাতীয় প্রচলিত শব্দ বলে। না ভাই, এমনটি করবেন না। সুন্নত হচ্ছে, মজলিস শেষে বা মোবাইলে কথা শেষে “السلام عليكم ورحمة الله وبركاته” বলে পূর্ণ সালাম দেওয়া। আমাদের উচিত পূর্ণ সালামের প্রচার-প্রসার করা।
আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিনয়ের একটি নমুনা হচ্ছে, হযরত আনাস বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চাদের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাদের সালাম দিতেন। তিনি শ্রেষ্ঠ নবী, শ্রেষ্ঠ মাখলুক, তিনি বাচ্চাদের সালাম দিতেন। কিছুলোক খেলাধুলায় মত্ত বাচ্চাদের পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাদের সালাম দেয় না, তাদের গুরুত্ব দেয় না। না ভাই, তাদেরও সালাম করুন।
কিছুলোক আছে যারা কোনো ব্যক্তির সাথে ছোট বাচ্চা থাকলে শুধু বাচ্চার পিতাকে সালাম দেয়, বাচ্চাকে সালাম দেয় না। এটা ভুল, এটা খেলাফে সুন্নত। আপনি বরং বাচ্চাকেও সালাম দিন। এটি রাসূলে হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত। আমাদেরকে তাঁর সুন্নত মোতাবেক সালামের প্রচার-প্রসার করা উচিত। সালাম এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“حق المسلم على المسلم أنه إذا لقِيه فإنه يُسلِّم عليه”
“এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের হক হলো সাক্ষাতে সালাম দেওয়া”। (তিরমিজি, হাদীস নং- ২৭৩৭)
তাদের মাঝে সর্বোত্তম সেই যে আগে সালাম দেয়। সবসময় আগে সালাম দেওয়া, আগে অভ্যর্থনা জানানো বিনয় ও উদারতার পরিচায়ক। তাই পরস্পর সালাম দেওয়া, আগে সালাম দেওয়া আমাদের অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু শুধু সালাম দেওয়ার জন্য বাজারে যেতেন। কেননা সালামের রয়েছে মহা প্রতিদান। আল্লাহ তাআলা সালামকারীকে ভালোবাসেন।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম