দারসে রমাদান।। দারস-১২।। তাওবা।।

0
158

তাওবা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আমাদের মতো গুনাহগারদের জীবনে তাওবার গুরুত্ব অপরিসীম। গুনাহ থেকে ফিরে এসে, অনুতপ্ত হয়ে আর কখনও গুনাহ না করার সংকল্প করার নাম তাওবা। আমরা যদি রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনী পর্যালোচনা করি তাহলে দেখব যে, তাওবা ছিল তাঁর দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সহীহ হাদিসে এসেছে, তিনি বলেছেন,

” يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إلى اللهِ، واستغفروه فإنِّي أَتُوبُ إلى الله في اليوم مائة مرة” وفي رواية “سبعين مرة”
অর্থ: হে লোকসকল, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার কর। কেননা আমি দৈনিক শতবার আল্লাহর কাছে তাওবা করি। অপর বর্ণনায় সত্তরবারের কথা এসেছে। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-১৮২৯৩)

দশ-বিশ বা ত্রিশ নয়; দৈনিক শতবার তিনি তাওবা করতেন। যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, আজকে আল্লাহর কাছে তাওবা করেছেন? তাহলে সে আপনার দিকে চোখভরা বিস্ময় নিয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাকাবে। বলবে, আপনি কি আমাকে মন্দকাজের অপবাদ দিচ্ছেন? আমাকে যিনা, মদ্যপান, সুদ-ঘুষ খাওয়া বা নামায ত্যাগ করার মতো কোনও অপরাধ করতে দেখেছেন? তাহলে কেন তাওবা করতে বলছেন?
এই হতভাগা ভাই জানেন না যে, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—যিনি সকল ছোট-বড় গুনাহ থেকেও পবিত্র ছিলেন—দৈনিক শতবার তাওবা করতেন।
আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এক মজলিসেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শতবার তাওবা করতেন। লক্ষ করুন! একদিনে নয়; আমাদের এই মজলিসের মতো এক মজলিসে!

সুনানে আবু দাউদ ও তিরমিযীতে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমার একটি হাদীস আছে। হাদিসটিতে খেয়াল করুন! সাহাবাগণ কীভাবে রাসূলকে পরখ করতেন; এমনকি তাঁর ঠোঁটযুগলের নাড়াচাড়াও খেয়াল করতেন। তিনি বলেন,
“كنّا نعدّ لرسول الله صلى الله عليه وسلم في المجلس الواحد مائة مرة ربّ اغفر لي وتب علي إنّك أنت التواب الرحيم”
অর্থ: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মজলিসে শতবার
“رَبِّ اغْفِرْ لِي، وَتُبْ عَلَيَّ، إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرحيم” পড়েছেন। আমরা তা গণনা করেছি। (আবু দাউদ, হাদিস নং- ১৫১৬, তিরমিজি, হাদিস নং-৩৪৩৪)

প্রিয় ভাইয়েরা, সকলে নিজেকে যাচাই করি। জীবনে কতবার এই হাদিসের ওপর আমল করেছি, কতবার এক মজলিসে শতবার তাওবা-ইস্তেগফার করেছি? সুবহানাল্লাহ! হযরত আলী রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, “কোনও ব্যক্তি ইস্তেগফার করছে আর আল্লাহ তাআলা তাকে আযাব দিতে ইচ্ছা করেছেন, এমন হতে পারে না”। আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا كَانَ اللّهُ مُعَذِّبَهُمْ وَهُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
অর্থ: বান্দাগণ তাওবা করার হালতে আল্লাহ তাআলা তাদের আযাব দেন না।
অপর এক আয়াতে কাফেরদের বাদ দিয়ে শুধু মুমিনদের সম্বোধন করে বলেন,
وَتُوبُوا إِلَى اللَّهِ جَمِيعاً أَيُّهَا الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ
অর্থ: হে মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তাওবা কর। যেন তোমরা সফল হতে পার।

সুতরাং, কামিয়াবি, সফলতা ও মুক্তির একটি উপায় হচ্ছে, আল্লাহর কাছে তাওবা করা।
আফসোস! শত আফসোস!! কিছু মানুষকে নিয়ে শয়তান খেলা করে। তার হালত হচ্ছে, যদি সে গুনাহ করে ফেলে আর আপনি তাকে বলেন, কেন আপনি আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করছেন না? তাহলে সে বলবে, গতকাল মাত্র গুনাহ করেছি, আগামী দুইদিন পর আবার সেই গুনাহে লিপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি জানি না কেন এমন হয়। এর কী কারণ তা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। আমি কিছুদিন পর আবার সেই গুনাহ করব, অতঃপর তাওবা-ইস্তেগফার করব, অতঃপর পুনরায় সেই গুনাহ করব, অতঃপর…।

ইমাম হাসান আল-বসরী রহিমাহুল্লাহর কাছে একলোক এসে বলল, “একলোক গুনাহ করে অতঃপর তাওবা করে। পুনরায় গুনাহ করে অতঃপর তাওবা করে। অতঃপর আবার গুনাহ করে। তাহলে সে কি তাঁর রবের কাছে আবার তাওবা করতে লজ্জাবোধ করবে না?” ইমাম হাসান আল-বসরী তার জবাবে চমৎকার কথা বলেছেন। স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো সেই কথা! তিনি বলেছেন,
“ودّ الشيطان لو ظفر منكم بهذا”
“শয়তানের আকাঙ্ক্ষা, সে যদি তোমদেরকে এমন চিন্তায় লিপ্ত রেখে বিজয়ী হতে পারত! (অর্থাৎ, তাওবা-ইস্তেগফার থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারত।)

অর্থাৎ, এমন চিন্তা শয়তানের কাছে খুবই পছন্দের। শয়তানের লক্ষ্যই হচ্ছে, আপনাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করা। আল্লাহর থেকে নিরাশ হলে আপনি শেষ। কিছুলোক বলে, তুমি ধ্বংস, তুমি শেষ, তুমি ব্যর্থ। তাই, হে গুনাহে অভ্যস্ত লোক, তুমি গুনাহ চালিয়ে যাও। না; কখনও না! এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা। এটা মিথ্যা কথা। বরং, যখনই আপনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার দরবারে তাওবা-ইস্তেগফার করে আল্লাহর পথে ফিরে আসলেন, তখনই আপনি শয়তানকে পরাভূত করলেন। চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিলেন। শয়তান কখনও চায় না যে, আপনি আল্লাহর কাছে তাওবা করেন। গুনাহ হয়ে গেছে? ব্যস, এখনই তাওবা করুন। একমাস পর আবার গুনাহে পতিত হয়েছেন? আবার তাওবা করুন। আবার গুনাহ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন? তবুও, এখনই তাওবা করুন। এমনও তো হতে পারে, তাওবা করার পর আপনি মারা গেছেন। তাহলে আপনি আল্লাহর কাছে তাওবাকারী অবস্থায় মিলিত হবেন।

সুনানে আবু দাউদ, তিরমিযীতে একটি হাদিস আছে। ইমাম হাকিম হাদিসটি ইমাম মুসলিমের শর্তে উত্তীর্ণ বলেছেন। কিছু আলেম হাদিসটি হাসান বলেছেন। ইমাম নববী রিয়াজুস সালিহীন কিতাবে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি এই; নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“من قال أستغفر الله الذي لا إله إلا هو الحي القيوم وأتوب إليه غُفرت ذنوبه وإن كان فرَّ من الزَّحفِ ”
অর্থ: যে ব্যক্তি “أسْتَغْفِرُ اللهَ العَظِيمَ الَّذِي لاَ إلَهَ إلاَّ هُوَ، الحَيُّ القَيُّومُ، وَأتُوبُ إلَيهِ” বলবে, তার সকল গুনাহ মাফ করা হবে। যদিও সে যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়নকারী হয়। (আবু দাউদ, হাদিস নং-১৫১৭)
আর আপনারা জানেন, যুদ্ধের ময়দান থেকে পলায়ন করা কবীরা গুনাহ।

সুতরাং, হে প্রিয় ভাই, বেশি থেকে বেশি তাওবা-ইস্তেগফার করুন। সালাফগণ বলেন,
“أصبحوا تائبين وأمسوا تائبين” অর্থাৎ, সকাল-সন্ধ্যা তাওবাকারী অবস্থায় যাপন কর। মানুষ গুনাহের কারণে অনেক ইবাদত-আনুগত্যের কাজ থেকে বঞ্চিত হয়। তাই, তাওবা-ইস্তেগফারকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ বানাতে হবে। তাওবা কেবল ফাসেক-ফাজের, অপরাধীদের জন্য— এমন ধারণা ও বিশ্বাস রাখবেন না। তাওবা-ইস্তেগফার সকল মুমিনের জন্য সকাল-সন্ধ্যা জরুরি। নিজের যবানকে এর জন্য তরবিয়ত দিতে হবে। লুকমান হাকীম তার ছেলেকে বলেন, “হে বৎস, যবানে “اللَّهُمَّ اغْفِرْ لي” জারি রাখ। আল্লাহর এমন কিছু সময় আছে, যখন তাঁর কাছে প্রার্থনাকারীকে তিনি ফিরিয়ে দেন না”।

ইমাম হাসান আল-বসরী আমাদেরকে মূল্যবান নসীহত করেছেন। তিনি বলেছেন, “ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, বাজারে-বন্দরে বেশি বেশি ইস্তেগফার পড়ুন। কেননা আপনি জানেন না, আল্লাহর মাগফিরাত ও ক্ষমা কখন নাজিল হবে”।
আপনি যেখানেই থাকুন, যে কাজেই থাকুন, বেশি বেশি তাওবা-ইস্তেগফার পাঠ করুন ও যবানে জারি রাখুন।
নিজের গুনাহের দিকে তাকিয়ে দেখুন! আপনি তাওবা-ইস্তেগফারের প্রতি কত মুখাপেক্ষী। আপনি কত গুনাহ করেছেন, কত নেক আমল ত্যাগ করেছেন। সাবধান! নিজেকে কখনও কামেল ও পরিপূর্ণ খাঁটি মুমিন ভাববেন না। আমি আলহামদুলিল্লাহ অনেকের থেকে ভালো। আমি নামাযী, রোযাদার, তিলাওয়াতকারী, তাহাজ্জুদগুজার, দানশীল, ইত্যাদি, ইত্যাদি…। না ভাই, এভাবে ভাববেন না। বরং, এভাবে ভাবুন— আমি অনেক গুনাহগার, আমার নেক আমলে অনেক ঘাটতি আছে। আমরা প্রতিদিন আল্লাহর কাছে বহুবার, শতবার, হাজারবার তাওবা করার মুখাপেক্ষী।


মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিলিস্তিনের জিহাদ || আপডেট – ২৪ মার্চ, ২০২৪
পরবর্তী নিবন্ধশাবাবের নিয়ন্ত্রণে আরও একটি সোমালি সেনা ঘাঁটি: নিহত ৫৭ শত্রু সেনা