কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি সৌমিত্র শেখরের বাংলো থেকে উদ্ধার হলো ওএমআর ও শিক্ষার্থী ভর্তির সুপারিশ পত্র

0
90

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য সৌমিত্র শেখরের ব্যবহৃত বাংলোয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার অব্যবহৃত ওএমআর শিট (উত্তরপত্র) পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে বাংলো থেকে শিক্ষার্থী ভর্তির সুপারিশ করে ময়মনসিংহের সদ্য সাবেক দুজন সংসদ সদস্যের (এমপি) ডিও লেটার (আধা সরকারি চাহিদা-পত্র) উদ্ধার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। দুখু মিয়া নামের এই বাংলো থেকেই গুচ্ছ পদ্ধতির ২২টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে অনিয়ম হতো বলে অভিযোগ করেছে শিক্ষকেরা।

বাংলোটিতে আরও বিভিন্ন ধরনের ‘স্পর্শকাতর নথিপত্র’ পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে গত ১৪ আগস্ট উপাচার্য পদ থেকে পদত্যাগ করে ক্যাম্পাস ছাড়ে সৌমিত্র শেখর। পদত্যাগের পর সৌমিত্র শেখর বাংলোতে থাকা মালামাল সরিয়ে নিতে চাইলে শিক্ষার্থীরা বাধা দেয়। তখন থেকে ওই অবস্থায় বাংলোটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জিম্মায় ছিল। এরপর ১৭ অক্টোবর বিভিন্ন নথিপত্র জব্দ করে বাংলোটি সিল-গালা করে প্রশাসন। সেদিন সৌমিত্র শেখরের ব্যক্তিগত কিছু মালামাল বাংলো থেকে নিয়ে গেছে তার প্রতিনিধিরা।

ময়মনসিংহের ত্রিশালে অবস্থিত নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ উপাচার্য হিসেবে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর যোগদান করে সৌমিত্র শেখর। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর এসব অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের তথ্য অনুযায়ী, উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সৌমিত্র শেখর ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে।
শেখর ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভর্তি-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিল। পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। অবৈধ অর্থে শেরপুরে জমি কিনে ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করার অভিযোগ পেয়েছে দুদক। তার বিরুদ্ধে ঢাকার ধানমন্ডি ও উত্তরায় একাধিক ফ্ল্যাটের মালিকানা এবং শেরপুরে সম্পত্তির তথ্য পেয়েছে দুদক।

সৌমিত্র শেখরের বাংলো ছাড়ার পর থেকেই সেখানে বিভিন্ন ধরনের ‘স্পর্শকাতর নথি’ থাকার অভিযোগ ওঠে। সাংবাদিকেরা এ বিষয়ে প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সোমবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে সিলগালা করা বাংলোটি ঘুরে দেখায় ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর মাহবুবুন নাহারের নেতৃত্বে একটি দল।

গণমাধ্যমগুলো সরোজমিনে দেখতে পায়, বাংলোর দোতলায় একটি কক্ষও সিলগালা। এটি উপাচার্যের শয়নকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভেতরে দুটি আলমারিও সিলগালা। আলমারির তালা খুলে ভেতরে ভর্তি পরীক্ষার ওএমআর শিট পাওয়া যায়। সেখানে ছাত্র ভর্তির সুপারিশ করে উপাচার্য বরবার ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজীম উদ্দিন আহমেদের দেওয়া ডিও লেটার ছিল। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই ডিও দেওয়া হয়েছিল। আরেকটি ডিও দিয়েছে ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ। সে(ওই এমপি) গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি চিঠি দেয়। এ ছাড়া ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য রুহুল আমিন মাদানী ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সুপারিশ করা পৃথক দুটি ভর্তির আবেদনপত্রও দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভবনে পাওয়া নথিপত্রের একটি জব্দ তালিকা তৈরি করেছে। এই তালিকায় রয়েছে ওএমআর শিট দুই খাম, জীবনবৃত্তান্ত, ভর্তি পরীক্ষার ফাইল, নিয়োগ খাতা তিনটি, মার্কেটিং বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ খাতা, তদন্ত প্রতিবেদন, ড্রাইভার নিয়োগ, জিএসটি প্রবেশপত্র, প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ, ফোকলোর ও সমাজকর্ম নিয়োগ খাতা, মার্কেটিং বিভাগের অফিস সহায়ক নিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগ খাতা, বাস হেলপার নিয়োগ খাতা, প্রকল্প বিল ভাউচার, ট্রেজারার নিয়োগ ফাইলসহ গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, গুচ্ছ পদ্ধতির এ, বি ও সি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা হয় কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরীক্ষার হলগুলোয় নির্দিষ্টসংখ্যক ও এমআরের সঙ্গে অতিরিক্ত দুটি করে ওএমআর দেওয়া হতো। পরীক্ষা শেষে সব ওএমআর নিয়ন্ত্রণ কক্ষে চলে যেত। সেখানেই চুক্তি করা ও তদবির থাকা শিক্ষার্থীদের ওএমআর পূরণ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

উল্লেখ্য, ২০২২, ২০২৩ ও ২০২৪ সালের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সৌমিত্র শেখরের উপচার্য থাকাকালীন হয়। তবে ২০২৪ সালের ভর্তি প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি গুচ্ছভুক্ত কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শূন্য আসনে ভর্তির ফলে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভও করে শিক্ষার্থীরা। মেধাতালিকায় পেছনে থাকা অনেকেই ভর্তির জন্য বিবেচিত হলেও সামনে থেকে অনেকে ভর্তির সুযোগ পাননি বলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

ওএমআর শিট উপাচার্যের আলমারিতে কীভাবে গেল, এমন প্রশ্নে ওএমআর প্যাকেজিং কমিটির সদস্যসচিব মাসুদ রানা বলেন, ‘উপাচার্য হয়তো দেখতে নিয়েছিলেন ওএমআরগুলো। তবে সেগুলো বাংলোতে নেওয়া ঠিক হয়নি। বিষয়টি খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেখা উচিত।’ এ ধরনের কোনো কাজে তার সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও দাবি করে মাসুদ রানা।

কিন্তু একই কমিটির সদস্য মানবসম্পদ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আতিকুর রহমান খান জানিয়েছে, ‘এ বছর অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার শুরুতে আমরা প্যাকেজিং করার সময় প্যাকেজিং কমিটির সদস্যসচিব (মাসুদ রানা) এসে বলে ভিসি স্যার কিছু ওএমআর চেয়েছেন। ভিসি ওএমআর দিয়ে কী করবেন, এমন প্রশ্ন উঠলে সদস্যসচিব নিজে ওএমআর নিয়ে যায়।’


তথ্যসূত্রঃ
১.সৌমিত্র শেখরের দুখু মিয়া বাংলোয় ভর্তি পরীক্ষার ওএমআর, এমপির ডিও
– https://tinyurl.com/c8epezdx

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকদিনেই গাজায় ১৪৩ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে সন্ত্রাসী ইসরায়েল
পরবর্তী নিবন্ধইসরায়েলকে বয়কটের ডাক বিশ্বের হাজারো লেখক-প্রকাশকের