আসাদ শাসনের পতন ও সিরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি

2
1006

সিরিয়ার প্রতিরোধ যোদ্ধারা বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন। মুজাহিদদের ১৪ বছরের দীর্ঘ লড়াই ও সিরিয়ানদের ত্যাগের বিনিময়ে আসাদ সরকারের উৎখাতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসান হয়েছে প্রায় ৬ দশক ধরে চলা বাথিস্ট শাসন ও আসাদ পরিবারের যুগের।

মুজাহিদিনরা গত নভেম্বরের ২৭ তারিখ, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চল থেকে বাসার আল-আসাদের বিরুদ্ধে “রদ্দুল উদওয়ান” নামে নতুন অপারেশন রুম ঘোষণা করেন। এরপর থেকে মুজাহিদিনরা সারা দেশে বিদ্যুৎ গতিতে অগ্রসর হতে থাকেন। এই ধারাবাহিকতায় মুজাহিদিনরা ২৯ নভেম্বর আলেপ্পো সিটির কেন্দ্রীয় শহর বিজয় করেন আর ১লা ডিসেম্বর ইদলিবের বাকি অংশ শত্রু মুক্ত করেন। এরপর ২ ডিসেম্বর হামার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন এবং ৫ ডিসেম্বর হামা সিটির কেন্দ্রীয় শহর বিজয় করেন। হামা বিজয়ের পর মুজাহিদিনরা হোমসের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন, এবং M5 মহাসড়ক হয়ে কেন্দ্রীয় শহরের কাছাকাছি চলে আসেন। হোমস ছিলো রাজধানী দামেস্কের প্রবেশ পথ, ফলে আসাদ বাহিনী ও হিজবুল্লাহ এখানে তার সর্বশক্তি দিয়ে মুজাহিদদের অগ্রগতি রুখার চেষ্টা করে।

এমন পরিস্থিতিতে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জনগণ ও স্থানীয় যোদ্ধারা মুজাহিদদের ঘোষিত অপারেশন রুমের সাথে সংহতি জানিয়ে ৬ ডিসেম্বর দারা ও সুওয়াইদায় আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এদিন মুজাহিদিনরা মাত্র ১৬ ঘন্টায় দুটি প্রদেশ আসাদ বাহিনী থেকে মুক্ত করেন এবং ইসরায়েল সীমান্তবর্তী কুনাইত্রার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। পরে ৭ ডিসেম্বর কুনাইত্রাও মুজাহিদিনরা বিজয় করে নেন।

এসময় আসাদ বাহিনী রাজধানী দামেস্ক রক্ষায় দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে। তখন আসাদ বাহিনী এসব এলাকা মার্কিন সমর্থিত ফ্রি সিরায়ান আর্মি ও কুর্দি বিদ্রোহীদের কাছে কোনো সমঝোতা করা ছাড়াই হস্তান্তর করে। ফলে মার্কিন সমর্থিত বিদ্রোহীরা পূর্বাঞ্চলের পালমিরা সহ বিস্তীর্ণ ভূমির দখল নেয়, অপরদিকে কুর্দি মিলিশিয়ারা দেইর ইজ-জোর অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় সুন্নি গ্রুপগুলো কুর্দিদেরকে দেইর ইজ-জোর সীমান্তে অগ্রসর হওয়া থেকে বিরত রাখেন।

আসাদ বাহিনী যখন পূর্ণ শক্তি নিয়ে হোমসের কেন্দ্রীয় শহরের উপকণ্ঠে লড়াই করছে, তখন মুজাহিদদের একটি অংশ কৌশলে হোমসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনমানবহীন মরুভূমি এলাকা দিয়ে রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। একই সময় দারা এবং কুনাইত্রার দিক থেকেও মুজাহিদিনরা দুই ভাগে রাজধানী দামেস্কের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। দেশের উত্তরাঞ্চলের মুজাহিদিনরা যখন রাজধানী থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এবং দক্ষিণাঞ্চলের মুজাহিদিনরা যখন দামেস্ক সিটির দক্ষিণে এসে পৌঁছান, তখন আসাদ সরকারের মুখপাত্র ঘোষণা করেন, রাত ৮টায় জাতির উদ্দেশ্য ভাষন দিবে বাশার আল-আসাদ। কিন্তু রাত ৮টায় আসাদ ভাষন দেওয়ার পরিবর্তে মিডিয়ার সামনে আসে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। এসময় সে মুজাহিদদের বিজয়গুলোকে অস্বীকার করে দাবি করে যে, “এসব কিছুই বিদ্রোহীদের মিডিয়া প্রোপাগান্ডা। আমাদের যোদ্ধারা আলেপ্পো, হামা এবং হোমসে এখন সাহসীকতার সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে”। ধারণা করা হচ্ছে, এই সময়টাতেই হয়তো বাশার আল-আসাদ ও তার পরিবার দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।

শত্রুর এমন বিবৃতির পরবর্তী মিনিটগুলোতে মুজাহিদদের হামলার তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। এই ধারাবাহিকতায় ৭ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৩০ মিনিট নাগাদ দারার দিক থেকে মুজাহিদিনরা রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহরের উপকণ্ঠে যুদ্ধ শুরু করেন। একই সময় দেশের উত্তরাঞ্চলের মুজাহিদিনরা হোমসের কেন্দ্রীয় শহরে ঢুকে পড়েন এবং সেখানকার কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বন্দীকে মুক্ত করেন। এসময় স্থানীয়দের ধারণ করা একাধিক ভিডিওতে দেখা যায়, মুজাহিদদের ভয়ে আসাদ বাহিনীর সদস্যরা সাঁজোয়া যানগুলো থেকে নেমে পড়ছে, নিজেদের গায়ের সামরিক পোষাক খুলে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলছে এবং সিভিলিয়ান বেশে পালিয়ে যাচ্ছে।

আর এভাবেই রাত যতো গভীর হচ্ছিল, মুজাহিদিনরা বিভিন্ন দিক থেকে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। সর্বশেষ স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় মুজাহিদিনরা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে প্রবেশ করেন। আর ৫টায় দেশটির জাতীয় টেলিভিশন থেকে মুজাহিদিনরা রাজধানী দামেস্ক আসাদ বাহিনী থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন। সেই সাথে রাজধানীর কুখ্যাত সিদনায়া কারাগারে বন্দী করে রাখা হাজার হাজার মানুষকে মুক্ত করেন মুজাহিদিনরা, যাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ বাহিনী আল-কাসসাম ব্রিগেডের ৬০ জন যোদ্ধা এবং ৬০০ জন ফিলিস্তিনিও ছিলেন।

এদিকে রাজধানীতে লুটতরাজ এড়াতে সন্ধ্যা ৪টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করেছেন প্রতিরোধ যোদ্ধারা। একই সাথে জনগণ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না মন্ত্রণালয়গুলো দায়িত্বশীলদের কাছে হস্তান্তর হচ্ছে। পূর্ববর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছে যে, সে তার দায়িত্ব নতুন সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে এবং দেশ ছেড়ে পালাবে না। প্রধানমন্ত্রী দারায় নিজ বাসভবন ছেড়ে দুপুরে রাজধানী দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে বলে জানা গেছে। একই সাথে রাজধানী দামেস্কে পৌঁছেছেন প্রতিরোধ দলগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারাও।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, লাতাকিয়া এবং তারতুস থেকে রাশিয়ান সেনাদের প্রত্যাহারের পর মুজাহিদিনরা অঞ্চল দুটির দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। একই সাথে দেইর ইজ-জোর এর দিকেও মুজাহিদদের একটি অংশ অগ্রসর হচ্ছেন, তবে কেন্দ্রীয় শহর এবং তেল সমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে মার্কিন বাহিনী। এনিয়ে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে চলছে মার্কিন বাহিনীর বৈঠক। অপরদিকে গোলান মালভূমি হয়ে সিরিয়ার দক্ষিনাঞ্চলীয় কুনাইত্রায় বিমান এবং স্থল হামলা চালাচ্ছে জায়োনিস্ট ইসরায়েল, এখন পর্যন্ত তারা সিরিয়ার একটি সামরিক চেকপয়েন্ট দখল করেছে।

2 মন্তব্যসমূহ

    • সামনের সময় এই বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করবে ইনশাআল্লাহ্‌। তবে কইদাতুল জিহাদ ইসলামের পথে যেকোন প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানায় যা সম্প্রতি বিভিন্ন বার্তায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। জাযাকাল্লাহু খাইরান

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধএবার দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দিল উগ্র হিন্দুত্ববাদী আরএসএস
পরবর্তী নিবন্ধগাজায় বর্বর ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি