মুসলিম সমাজের দুর্দশা সমাধানে ওআইসি’র ব্যর্থতা

0
3

২৫শে সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল আন্তর্জাতিক ইসলামী সহযোগী সংস্থা (সংক্ষেপে OIC)। জেরুজালেমে অবস্থিত মুসলমানদের প্রথম কিবলা মসজিদ আল-আকসায় অগ্নিসংযোগের প্রতিক্রিয়া হিসেবে সংগঠনটির জন্ম হয়েছিল। এটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করা, ইসলামী ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে সমর্থন জোগানো। প্রাথমিকভাবে এটি ‘ইসলামী সম্মেলন সংস্থা’ হিসেবে নামকরণ হয়েছিল, পরবর্তীতে ২০১১ সালে ‘ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা’ হিসেবে এটির নামকরণ করা হয়।

প্রতিষ্ঠালগ্ন উদ্দেশ্য সৎ হলেও তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মাঝে আন্তঃবিভাজন, রাজনৈতিক মতাদর্শে ভিন্নতা, সাম্যতার অভাব প্রভৃতি কারণ ন্যায়ভিত্তিক সামষ্টিক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সংস্থাটিকে সর্বদাই বাঁধাগ্রস্ত করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সদস্যদের জাতীয় স্বার্থ ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপর প্রাধান্য পেয়েছে।

এছাড়া সংস্থাটিতে শক্তিশালী প্রয়োগ ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন, আন্তঃমুসলিম সংঘাত ও সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মাঝে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের মতো গুরুতর সমস্যাগুলো কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার সক্ষমতা এটির নেই।

বিশেষত ফিলিস্তিনে বিগত বছর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলের চলমান আগ্রাসনের প্রেক্ষিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ওআইসি চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, যা সংস্থাটির দুর্বল অবস্থান সুস্পষ্ট করে তুলেছে। যদিও ওআইসি বারবার ইসরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে এসেছে এবং এর সমাধানের জন্য সমর্থন জানিয়েছে, কিন্তু তাদের এই আহ্বানের বাস্তব কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নি।

সম্মিলিত আন্তর্জাতিক চাপ বা কার্যকর নিষেধাজ্ঞার মতো সুদৃঢ় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে তাঁরা অক্ষমতা দেখিয়েছে। এতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সম্মিলিত কৌশলের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। এই ধরনের নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে যে, তাদের নিকট ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার তুলনায় নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করার প্রাধান্য বেশি। তাই ফিলিস্তিনের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় ওআইসি চূড়ান্তভাবে অকার্যকর একটি সংস্থা হিসেবেই দাঁড়িয়েছে।

ফলস্বরূপ বিশ্ব দরবারে ওআইসি’র প্রভাব যেমনটা হওয়ার কথা ছিল, সে তুলনায় তেমন কিছু অর্জিত হয় নি। তাই মুসলিম বিশ্বের প্রতিনিধি হিসেবে এটির সামগ্রিক কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।

ওআইসি’র বিরুদ্ধে সমালোচনার উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হল আফগানিস্তানে ২০ বছরের মার্কিন আগ্রাসন। এতে ওআইসি এর অবস্থান ছিল উদ্বেগজনক, যা তাদের নীতিগত পদক্ষেপের অভাব এবং মানবাধিকারের তুলনায় কৌশলগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করে। বাহ্যিকভাবে তাঁরা সন্ত্রাসবাদের নিন্দা জানিয়েছে সত্য, কিন্তু পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে তাঁরা পর্যাপ্ত তদন্ত পরিচালনা ও নিন্দা জানায় নি। এমনকি জঙ্গিবাদের মিথ্যা অজুহাতে দখলদার মার্কিন ও ন্যাটো জোটের প্রতি মৌন সমর্থন জানিয়েছে, যা সংস্থাটির প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করেছে।

আফগান ইস্যুতে নিরপেক্ষ নিন্দার পরিবর্তে দ্বিমুখী আচরণের কারণে তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। আফগান জনগণের দুর্ভোগের প্রতি এই সংস্থা অবজ্ঞা দেখিয়েছে। আফগান যুদ্ধে ওআইসি এর অকার্যকর ভূমিকা মুসলমানদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের প্রতি তার ঘোষিত প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতাকে প্রকাশ করে। তাঁরা মৌলিক মানবাধিকার নীতির পরিবর্তে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা সর্বদাই অগ্রাধিকার দিয়েছে।

ওআইসি আফগানিস্তানের নারী শিক্ষার প্রতি পশ্চিমাদের পন্থায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, একই সাথে ফিলিস্তিনের ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকে তাঁরা উপেক্ষা করে যাচ্ছে। যা থেকে মুসলিম সমাজে সত্যিকারের নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের সদিচ্ছার অভাব প্রতীয়মান হয়।

ফিলিস্তিনি নারীদের উপর দখলদার ইসরায়েলের পরিকল্পিত নিপীড়নকে ওআইসি বরাবরই উপেক্ষা করে গেছে, অপরদিকে নারী অধিকার বিষয়ক তাদের ক্ষোভ কেবল নির্দিষ্ট কিছু ইস্যুকে কেন্দ্র করে, যা মুসলিম উম্মাহর প্রতি তাদের প্রকৃত আন্তরিকতার অভাবকে প্রকাশ করে। প্রকৃতপক্ষে মানবাধিকারের তুলনায় রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাই যেন তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। এমন নির্লজ্জ দ্বিচারিতা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সদস্য রাষ্ট্রসমূহের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের দুরভিসন্ধি সংস্থাটির দুর্বলতাকে আরও সুস্পষ্ট করেছে।

পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীদের ব্যাপক যৌন হয়রানি নির্যাতনের বিষয়ে সংগঠনটি নীরব ভূমিকা পালন করে এসেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত নারী শিক্ষা বিষয়ক ওআইসি’র সম্মেলন আহ্বান হাস্যকরই বটে।

বাহাওয়ালপুর, ডেরা ইসমাইল খান ও বেলুচিস্তান সহ পাকিস্তান জুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলসমূহে সম্প্রতি নারী নির্যাতন সংক্রান্ত ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল। এই সকল ঘটনা নারী অধিকার ও শিক্ষা বিষয়ে ওআইসি এর কথিত প্রতিশ্রুতির স্পষ্ট বিরোধী।

ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক রীতিনীতির আড়ালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এই সকল অপরাধগুলো মোকাবেলা করতে সংস্থাটি ব্যর্থ হয়েছে। নারী ইস্যুতে কেবল বাছাইকৃত কিছু ইস্যু নিয়ে গুরুত্বারোপ করা প্রমাণ করে যে, মুসলিম নারীদের প্রকৃত কল্যাণ সাধনের চেয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাই ওআইসি’র উদ্দেশ্য।

মূল লেখক:ইঞ্জিনিয়ার দানিশ


তথ্যসূত্র:
1. OIC and the Plight of Muslim Women
– https://tinyurl.com/mr3kn3ym

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সীমান্তে গ্ৰেফতার দুই ভারতীয় নাগরিক