গুম, খুন ও ক্রসফায়ারে সোয়াট হয়ে উঠেছিল হাসিনার ‘জল্লাদ বাহিনী’

0
83

র‌্যাবের মতো সোয়াট বাহিনী ছিল এক বিভীষিকার নাম। শেখ হাসিনার আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যায় সোয়াটের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। কথিত চরমপন্থা মোকাবিলায় এ বাহিনী গঠিত হলেও হাসিনার সরকার একে ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে। সোয়াট বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘেরাও করে রাতে অভিযান পরিচালনা করেছে।

সোয়াট হচ্ছে স্পেশাল উইপন্স অ্যান্ড ট্যাকটিকস টিম। সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে ঢাকার বিশেষ পুলিশ ইউনিট কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) একটি বিশেষ দল। এই সোয়াট শেখ হাসিনার আমলে হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের ‘জল্লাদ বাহিনী’। গ্রেপ্তার বা আইনি প্রক্রিয়ায় কাউকে বিচারের জন্য উপস্থাপনের পরিবর্তে অনেক মানুষের জীবনে ভয়ংকর পরিণতি বয়ে এনেছিল সোয়াট। কখনো তা করা হতো প্রকাশ্য সংঘর্ষের নামে, কখনো বা অপারেশন ক্লিনআপের আড়ালে।

পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বাহিনীটিকে মূলত তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিয়ে জল্লাদের ভূমিকায় ব্যবহার করত। ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই এখন পলাতক। পালিয়ে যাওয়ার আগে দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময়ে রাষ্ট্রীয় এই বাহিনীকে জনসেবার বদলে করে গেছে চরম বিতর্কিত।

২০১৬ সালের জাহাজবাড়ী অভিযান সোয়াটের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। সাজানো ওই অভিযানে ৯ তরুণকে ডিবি থেকে বিশেষ পোশাক পরিয়ে কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিলে (জাহাজবাড়ী নামে পরিচিত) নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত’ দেখানো হয়। নিহতদের পরিবারগুলোকে লাশও দেওয়া হয়নি। পুরো অভিযানে সোয়াট সদস্যরা মূল ভূমিকা পালন করে।

পুলিশের অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে মূল ভূমিকা পালন করা সোয়াটের ওই তথাকথিত অভিযানে নিহত ৯ তরুণের মধ্যে একজন ছিল গার্মেন্টসকর্মী মতিউর রহমান। তার বাবা সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার ধানদিয়ে ইউনিয়নের ওমরপুর গ্রামের নাসির উদ্দিন। পেশায় তিনি একজন কৃষক। নাসির উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, “আমার ছেলে জঙ্গি ছিল না। তাকে মারার পর পুলিশ আমাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে ১৩-১৪ দিন আমাকে রেখে ওরাই বলেছিল ‘তোমার ছেলে জঙ্গি না’।”

এরপর ২০১৭ সালের মার্চে ঢাকার পান্থপথের হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে সোয়াটের অভিযানে সন্দেহভাজন ব্যক্তির ‘আত্মঘাতী’ হওয়ার দাবি করা হয়। গাজীপুরের পাতারটেক অভিযানেও একই কৌশল দেখা যায়। সেখানে সন্দেহভাজনদের আত্মসমর্পণের কোনো সুযোগ না দিয়ে সরাসরি গুলি চালানো হয়। পরিবারের অভিযোগ, নিহতরা আগে থেকেই গুম অবস্থায় ছিলেন। একই ভাবে সিলেটের আতিয়া মহলে চার দিনব্যাপী অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ না দিয়ে ভারী অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত সোয়াটের কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়, যেখানে সোয়াট সদস্যসহ নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজনও প্রাণ হারান।

চট্টগ্রামের আকবর শাহ এলাকার অভিযানে সরাসরি গুলি চালানো হয় এবং নিহতদের পরিচয় যাচাই না করার অভিযোগ ওঠে। মৌলভীবাজারের নাসিরপুরেও দিনের পর দিন চলা অভিযানে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হয়নি এবং বিস্ফোরণে নারী ও শিশুর প্রাণহানি ঘটে।

রাজশাহী ও বগুড়ায় তথাকথিত জঙ্গি দমন অভিযানে ছোট ঘর বা ফ্ল্যাট ঘিরে বিস্ফোরণ ও গুলি চালানো হয়, যেখানে নিহতদের পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষেত্রে নিহতরা নিরীহ ছাত্র বা ভুলভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।

গুম থেকে ফিরে আসা তরুণ প্রকৌশলী মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, “বাংলাদেশে ‘জঙ্গি দমনের’ নামে গত দেড় দশকে যে ভয়াবহ দমন-পীড়ন চলেছে, তার কেন্দ্রে ছিল পুলিশ সদর দপ্তরের অধীন সিটিটিসি ও তাদের স্পেশাল অপারেশন বাহিনী সোয়াট। এদের হাতেই নির্বিচারে প্রাণ গেছে বহু নারী-পুরুষ ও শিশুর। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহতদের পরিচয় অজানা থেকেছে। বিচার তো দূরের কথা, তদন্তও হয়নি। এই রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো, বিশেষ করে সোয়াটকে এক ধরনের জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিল তারা।”


তথ্যসূত্র:
১. হাসিনার শাসনে রাষ্ট্রীয় ‘জল্লাদ বাহিনী’ হয়ে ওঠে সোয়াট
– https://tinyurl.com/mr3eeecz

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধতালিবান সরকারের কান্দাহার পুলিশ কমান্ডে হাজার-ঊর্ধ্ব সামরিক যান সংস্কার
পরবর্তী নিবন্ধঢাবি ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে ফের ‘ট্রান্সজেন্ডার’ কোটা; কর্তৃপক্ষ বলছে ভুলবশত ব্যবহার হয়েছে