
০৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় ভারতীয় বিশ্বস্ত এজেন্ট আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা। পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবি চলতে থাকে। কিন্তু নানা অজুহাতে সেই দাবিকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। সর্বশেষে ফ্যাসিবাদের দোসর, সাবেক রাষ্ট্রপতি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ও বিচারের দাবিতে সরব হয় সকল মত ও পেশার মানুষ।
কতিপয় রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী সাংস্কৃতিক ফ্রন্টগুলো বাদে সকল মত ও পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পুনরায় তৈরি হয় জুলাইয়ের মতো ঐক্য। জনগণের দাবির মুখে অবশেষে আওয়ামী লীগের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ এবং বিচারিক কার্যক্রম শেষে দল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ১৩ মে এ-সংক্রান্ত একটি গেজেট জারি করা হয়।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের পর থেকেই নোংরা এক খেলায় মেতে ওঠে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছাত্র উপদেষ্টারা এবং নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে জড়ো হওয়া সমাবেশে ‘জাতীয় সংগীত’ অবমাননার অভিযোগ তুলে সর্বপ্রথম আওয়ামী বয়ানে ‘পাকিস্তানপন্থী’ সম্বোধন করে ফেসবুকে পোস্ট দেন ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। এরপর থেকে ছাত্রদের নতুন দল এনসিপির নেতারা ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কায়দায় মুসলিমদের লক্ষ্য করে বিভিন্ন আপত্তিকর মন্তব্য করতে থাকে। তাদের এই উস্কানি নতুন করে বিভাজনের দ্বার খুলে দেয়।
ছাত্রদের গঠিত দল এনসিপি একটি দলীয় বিবৃতির মাধ্যমে এই বিরোধে আরও ঘি ঢেলে দেয়। জাতীয় সংগীত ইস্যু ও একাত্তরের মুজিববাদী বয়ানকে সমর্থনে ৫০ বছর পূর্বে মীমাংসিত ঘটনাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে সামনে নিয়ে আসে।
এই ঘটনায় পরবর্তীতে এনসিপির ভাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘জাতীয় সংগীত’ গায় এবং আওয়ামীবাদী কায়দায় ‘একাত্তরের দালালরা হুঁশিয়ার, সাবধান’, ‘তোরা যারা রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’, ‘একাত্তরের প্রেতাত্মারা, হুঁশিয়ার সাবধান’ ইত্যাদি নানা স্লোগান দেয়।
হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের মূল ভিত্তি ছিল ‘একাত্তরের চেতনা’। এই চেতনার উপর ভর করেই সে ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সকল অপকর্ম থেকে মুক্তির একমাত্র কষ্টিপাথর ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তার এই মুজিববাদী বয়ানের ভিত্তিতে অসংখ্য মুসলিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের সকল কাজের বৈধতাও পেয়েছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামেই।
জুলাই অভ্যুত্থানে ‘ডাইনি হাসিনা’ ও তার প্রতিষ্ঠিত সকল বয়ানের অবসান ঘটে। যৌক্তিক কোটার দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতি’ বলে সম্বোধন করেছিল সে। পরবর্তীতে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের স্লোগানের কাছে ভেঙে পড়ে তার সেই রেটোরিক।
জুলাই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের অন্যতম স্লোগান ছিল—‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কী তোর বাপ-দাদার’ সহ আরও অনেক আওয়ামীবাদ বিরোধী স্লোগান।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে—আওয়ামী লীগ চলে যাওয়ার পর পুনরায় এই বয়ানকে জাগ্রত করার চেষ্টা কেন? কে বা কারা এই চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটাতে চাইছে? কী উদ্দেশ্য নিয়েই বা তারা এই বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে?
আওয়ামী লীগ আমলে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান দিয়ে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ হাসিল করেছে ভারত। মুসলিমদের উপর নির্যাতন বৈধ ধরে নেওয়া হতো ওই বয়ানের মাধ্যমে। একাত্তরের চেতনা জারি রাখতে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নানা কথিত সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট খোলা হয়েছিল। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে পুরো মিডিয়া জুড়ে বহাল তবিয়তে প্রতিষ্ঠিত ছিল চেতনার সেই বয়ান।
আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়ে পালালেও বহাল তবিয়তে রয়েছে তার সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ও মিডিয়া। তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ইস্যুতে সেই বয়ান প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে।
নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির লক্ষ্য ক্ষমতা। তাই ক্ষমতার স্বাদ পেতেই কি তারা পুনরায় একাত্তরের চেতনা জাগ্রত করে ভারতের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে? তারা কি হাসিনার প্রতিষ্ঠিত চেতনাধারী মিডিয়া ও ফ্যাসিবাদের সহযোগী সাংস্কৃতিক সংগঠনের কোলে উঠার চেষ্টা করছে? এই প্রশ্নগুলো রয়েই যায়!
তথ্যসূত্র:
১. সমাবেশে দলীয় স্লোগান ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনে বাধা দেওয়া প্রসঙ্গে এনসিপির বিবৃতি
-https://tinyurl.com/h4u3w7r2
২. আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি
-https://tinyurl.com/rzuuj7ue