ধারা ৩৭০ বাতিলের ছয় বছর: কাশ্মীরে গণহত্যা আর দমন-পীড়নের নির্মম ইতিহাস

0
70

ভারতের বিজেপি-নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী সরকার ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫/এ ধারা বাতিল করার পর থেকে গত ছয় বছরে ভারতীয় অবৈধভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে সামরিক দমন-পীড়নের মাত্রা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্বিচারে আটক, নির্যাতন, ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বেসামরিক সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ, সেবা প্রদানে অস্বীকৃতি এবং তীব্রতর ঘেরাও ও তল্লাশি অভিযানসহ নানাভাবে এই দমন-পীড়ন চলছে।

বিজেপি সরকারের নৃশংস এই পদক্ষেপের ছয় বছর পূর্তি উপলক্ষে ৫ আগস্ট, মঙ্গলবার কাশ্মীর মিডিয়া সার্ভিসের গবেষণা বিভাগ একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী এই সময়ের মধ্যে ২১ জন মহিলা এবং ৪৪ জন ছেলে সহ ১ হাজার ৩০ জন কাশ্মীরিকে শহীদ করেছে। ভুয়া এনকাউন্টার বা পুলিশ হেফাজতে ২৭৪ জন কাশ্মীরি প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এপিএইচসির জ্যৈষ্ঠ নেতা মুহাম্মদ আশরাফ সেহরাই, আলতাফ আহমেদ শাহ এবং গোলাম মুহাম্মদ বাট। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় সেনা, আধাসামরিক বাহিনী এবং পুলিশ কর্তৃক শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারী এবং শোকাহতদের উপর গুলি, ছররা গুলি এবং টিয়ারগ্যাসের শেল নিক্ষেপ সহ নৃশংস শক্তি প্রয়োগের ফলে অন্তত ২ হাজার ৫৫১ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১১, ২০১২, ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ এবং ২০১৯ সালে রেকর্ডকৃত হত্যাকাণ্ডের চেয়েও ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী হত্যাকাণ্ড এবং নৃশংসতার ঘটনা বেশি ঘটেছে। এতে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ভুক্তভোগীকে ভুয়া এনকাউন্টার এবং ভূখণ্ডজুড়ে সহিংস ঘেরাও এবং তল্লাশি অভিযানের আড়ালে হেফাজতে হত্যা করা হয়েছে।

অনেক যুবককে তাদের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে মুজাহিদিন বা প্রতিরোধ সংগঠনের স্থল কর্মী হিসেবে মিথ্যাভাবে চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত বেশিরভাগ যুবকের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইন (পিএসএ) এবং বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (ইউএপিএ) এর মতো কঠোর আইনের অধীনে মামলা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ৭৬ জন নারী বিধবা এবং ২০৮ জন শিশু এতিম হয়েছে। সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রীয় রাইফেলস, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, বিশেষ অপারেশন গ্রুপ এবং অন্যান্য বাহিনীর সমন্বয়ে ভারতীয় বাহিনী অধিকৃত অঞ্চল জুড়ে ২২ হাজার ৩৮৫টি ঘেরাও ও তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করেছে এবং বাড়িতে অভিযানের সময় ১ হাজার ১৬৫টিরও বেশি বাড়ি ও স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এছাড়া ১৩৭ জন নারীকে শ্লীলতাহানি করেছে বা অপমান করেছে এবং তিন ডজনেরও বেশি নারী ও মেয়েসহ ২৯ হাজার ৫৬৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

২০১৯ সালে ভারতের অবৈধ পদক্ষেপের পর থেকে জম্মু-কাশ্মীরে জীবন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এই পদক্ষেপের লক্ষ্য ছিল ভূখণ্ডের মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার পরিবর্তন করা এবং তাদের দীর্ঘস্থায়ী দাবিকে দুর্বল করা।

সমগ্র অধিকৃত অঞ্চলটিকে কার্যকরভাবে একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ আগস্টের আগে বা পরে হাজার হাজার হুরিয়ত নেতাকর্মী, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, নারী, ব্যবসায়ী, উলামা, সুশীল সমাজের সদস্য এবং যুবকদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অনেকেই এখনও জম্মু-কাশ্মীর এবং ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী রয়েছে।

আরএসএস-অনুপ্রাণিত বিজেপি নেতৃত্ব এই অঞ্চলের মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলতে চাইছে। পাঠ্যক্রম এবং ঐতিহাসিক আখ্যান বিকৃত করা হচ্ছে। অন্যদিকে কাশ্মীরি, উর্দু এবং ইংরেজির মতো স্থানীয় ভাষার বিনিময়ে হিন্দি এবং সংস্কৃত ভাষা প্রচার করা হচ্ছে।

স্বাধীনতার পক্ষে থাকা কাশ্মীরিদের সম্পত্তি ইউএপিএ-র মতো কালো আইনের আওতায় জব্দ করা হচ্ছে যাতে তারা তাদের ন্যায্য সংগ্রাম ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সামরিক শক্তির উপর ভরসা করে গড়ে ওঠা বিজেপি সরকার মুসলিম ভোটকে বিভক্ত করে বিজেপির হিন্দু প্রার্থীদের পক্ষে ভোটারদের পুনর্বিন্যাস করেছে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করার চলমান প্রচেষ্টায় বিজেপি সরকার মিথ্যা অভিযোগে শতাধিক সরকারি কর্মচারীকে বরখাস্ত করেছে এবং একই সাথে অ-রাষ্ট্রীয় প্রজাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। ফলে স্থানীয় জনগণ আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

ভারত কাশ্মীরে তার ঘৃণ্য উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নৃশংস কৌশল ব্যবহার করে চলেছে। ভারত কর্তৃক কাশ্মীরের উপর চাপিয়ে দেওয়া দমন-পীড়নের চিত্র ভয়াবহ ও গভীর উদ্বেগজনক। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর থেকে এই অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন যেন নতুন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, আটক, নির্যাতন, ঘরবাড়ি ধ্বংস, নারীদের লাঞ্ছনা—এই সবই প্রমাণ করে যে কাশ্মীরিদের রাজনৈতিক মতপ্রকাশের অধিকারকে রুদ্ধ করে ভারত সেখানে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখতে চাইছে।
তবে অবিরাম নিপীড়ন সত্ত্বেও, জম্মু-কাশ্মীরের জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে অবিচল রয়েছে। ভারতীয় বর্বরতা তাদের চেতনা দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে।


তথ্যসূত্র:
1. Kashmir Under Siege: Years of Repression Since Article 370’s Revocation
– https://tinyurl.com/nhfecca7
2. 5 YEARS AFTER REVOCATION OFARTICLE 370/35-A
– https://tinyurl.com/bdmmmapm

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধফটো রিপোর্ট ।। নতুন ইউনিফর্মে সজ্জিত ইমারতে ইসলামিয়ার বিশেষ পুলিশ বাহিনী
পরবর্তী নিবন্ধবুরকিনা ফাসোতে ‘জেএনআইএম’ মুজাহিদদের সামরিক কার্যকলাপের মানচিত্র