আদানির লুটপাট বহাল রাখতে পরীক্ষামূলক-ভাবে চালুর ৮ মাস অতিবাহিত হলেও বন্ধ পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র

0
23

কয়লা আমদানি জটিলতায় থমকে আছে পটুয়াখালী ১৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পরীক্ষামূলক-ভাবে চালুর ৮ মাস অতিবাহিত হলেও বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু না করায় রাষ্ট্রের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।

কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে চার দফা দরপত্র ডেকেও বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। ভারতের আদানি গ্রুপের চড়া দামের বিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে ‘লুণ্ঠন’ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে দেশের বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলোকে নানান অজুহাতে বসিয়ে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ বিশেষজ্ঞদের।

চার দফায় দরপত্রে অংশ নিয়ে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা সরবরাহের সুযোগ না দেওয়ায় ‘সিন্ডিকেটের অনিয়ম’ তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের হস্তক্ষেপ চেয়ে চিঠি দিয়েছে সিঙ্গাপুর-ভিত্তিক কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ইয়াংথাই এনার্জি। প্রধান উপদেষ্টার কাছে করা অভিযোগে বিগত সরকার থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এই খাতের নানা অনিয়ম ও হয়রানির বিবরণ তুলে ধরেছে প্রতিষ্ঠানটি।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, পটুয়াখালী জেলার পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের অদূরে কলাপাড়া উপজেলায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রটি বাংলাদেশ সরকারের মালিকানাধীন রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করে। ৯৫০ একর আয়তন জায়গাজুড়ে আরএনপিএল নামের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের আগস্টে।

মোট নির্মাণ ব্যয়ের দুই দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে এক দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ। ১৫ বছরমেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। চুক্তিতে প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী মাস থেকে সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ নামের বোঝা বহন করতে হবে। তবে সব প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর ৮ মাস পার হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়।

কয়লা নেই, বাণিজ্যিক উৎপাদনও নেই

জানা যায়, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য গত জানুয়ারিতে প্রস্তুত হয়। প্রথমদিকে প্রতিদিন ১১০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয় এই কেন্দ্র থেকে। পর্যায়ক্রমে তা এখন ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলছে। কেন্দ্রটি থেকে প্রতি মাসে সাড়ে ১০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা। ২৫ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলার পর অন্তত সাড়ে ৭ মিলিয়ন ডলারের (জ্বালানি খরচ বাদে) বিদ্যুৎও উৎপাদন হচ্ছে না। এতে কেন্দ্রের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত করতে ২০ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। দেশের বিদ্যুতের বার্ষিক চাহিদার ১০ শতাংশ মেটানোর জন্য এই কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম। তবে প্রয়োজনীয় কয়লার জোগান না থাকায় বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারছে না। একই কারণে এখনো এটির সিওডি সম্পন্ন হয়নি বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটির শতভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে উল্লেখ করে একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফ্লাই অ্যাশ সাইলো, ফুয়েল-ওয়েল পাম্প, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা, ফায়ার স্টেশন পরিষেবা এবং অগ্নিনির্বাপক পানির ট্যাঙ্ক, বয়লার, পাওয়ার হাউস, টারবাইন, জেনারেটর, চিমনি, বর্জ্য পানি সংরক্ষণাগার বেসিন, প্রশাসনিক ভবন, প্রকৌশল ভবন, মাল্টিপারপাস হল, ওয়ার্কশপসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ডরমিটরি, ক্যান্টিন ও মসজিদের পাশাপাশি আমদানি করা কয়লা খালাসের জন্য কনভেয়ার বেল্টসহ আধুনিক জেটি নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে।

কয়লা সরবরাহ নিয়ে জটিলতা

সংশ্লিষ্ট সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর নির্ধারিত সময় পার হলেও কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না সরকার। এতে চিহ্নিত পুরোনো সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বিগত সাড়ে ১৫ বছর ধরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ- সংশ্লিষ্টরা যেভাবে বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করে আসছিল, এখনো তারাই এ খাতটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে পটুয়াখালী আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘নসরুল হামিদ সিন্ডিকেট’-এর বাধায় কয়লা আমদানির জন্য চারবার দরপত্র ডেকেও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিল করায় এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দরপত্রে কারিগরি ও আর্থিক মূল্যায়নের বিভিন্ন ধাপে ত্রুটি থাকায় চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। শিগগিরই নতুন করে দরপত্র আহ্বান করা হবে।

কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকার পরও চালু না করায় আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে সরকারকে জরিমানা গুনতে হবে।

আদানির উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ আমদানি বহাল রাখতে কারসাজি

ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানি করে লুণ্ঠন ব্যবস্থা বহাল রাখতে পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিসহ দেশের প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো হয়নি বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, শুধু পটুয়াখালীর ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু করলে আদানির কাছ থেকে আর বিদ্যুৎ এনে দেশের কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হতো না। এখানে সুবিধাভোগী শ্রেণির আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকায় তারা কোনোভাবেই দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে চায় না। আগের লুণ্ঠনকারী সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করত, এই সরকারও সেখান থেকে বের হতে পারেনি বলে মনে করেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করেছিলাম আগের সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে যে অলিগার্ক তৈরি করে গেছে, সেটা ভাঙা হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এক বছর পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই অলিগার্কের থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারিনি। বরং তাদের দ্বারা সরকার ঘেরাও হয়ে গেছে। আগের সেই সুবিধাভোগী শ্রেণিই এ খাতের নিয়ন্ত্রণ করছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করতে পারলে ফার্নেস ওয়েলের মতো উচ্চ ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন হতো না। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। এ ছাড়া প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর চাপ কম হতো। সেই গ্যাস আমরা শিল্পে সরবরাহ করতে পারলে শিল্প-কারখানার মালিকরাও কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন। এখন সরকার অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ের দেশি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখছে। আবার ভারতের আদানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আসলে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকারকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন জ্বালানি খাতের এই বিশেষজ্ঞ।


তথ্যসূত্র:
১. আদানির লুটপাট বহাল রাখতে বন্ধ পটুয়াখালী বিদ্যুৎকেন্দ্র
– https://tinyurl.com/3426sabx

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘শেখ হাসিনার সাথে রাজনীতি করেছি’ বলে বেড়ানো কর্মকর্তা এখন মৃত্তিকার ডিজি; শেল্টার দিচ্ছে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তা
পরবর্তী নিবন্ধপ্রভাব খাটিয়ে স্বজাতি হিন্দুদের কাছ থেকেও কোটি টাকা লুট করে শ্যামল দত্ত