৯/১১ এর প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ: একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ

0
152

( ৯/১১ এর প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ সম্পর্কে “আল ফিরদাউস” এর সম্পাদক মুহতারাম ইবরাহীম হাসান হাফিযাহুল্লাহ’র নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ )

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর (৯/১১) হামলাটি ছিল বিশ্বজুড়ে নির্যাতিত মুসলিমদের পক্ষে আল-কায়েদার প্রতিশোধমূলক এবং শত্রুর বিরুদ্ধে ন্যায্য প্রতিক্রিয়া। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা বারবার মুসলিম বিশ্বকে শোষণ করেছে, মুসলিমদের ভূমি, সংস্কৃতি ও ধর্মের ওপর হামলা চালিয়েছে। এই হামলা ছিল সেই দীর্ঘকালীন আগ্রাসনের প্রতি মুসলিমদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

৯/১১ এর পূর্বে, আমেরিকা ও পশ্চিমা জোট মুসলিম ভূমি ইরাকের ওপর টানা দশ বছরের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। মানব ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে কঠোর ও দীর্ঘস্থায়ী অবরোধগুলোর একটি। সামরিক আগ্রাসন ব্যতীতই এই অবরোধে অর্ধ মিলিয়ন নারী ও শিশুর মৃত্যু ঘটে। যুদ্ধের চাইতেও ভয়াবহ এই নিষেধাজ্ঞায় নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের এক বিশাল সংখ্যা প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে এটি ছিল যেকোনো সামরিক যুদ্ধের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

এর আগে, ফিলিস্তিনে ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি আগ্রাসন চলে। এতে চার মিলিয়নের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়, ঘরবাড়ি, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়। আর এসবের পেছনে অবৈধ রাষ্ট্র ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহায়তা দিয়েছে আমেরিকা।

শাইখ উসামা ও তাঁর সঙ্গীরা বহু আগেই আমেরিকাকে সতর্ক করে বলেছিলেন ইরাকের অবরোধ তুলে নিতে, আরব স্বৈরশাসকদের সমর্থন বন্ধ করতে, দখলদার ইসরায়েলকে সহায়তা না করতে এবং জাজিরাতুল আরব থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করতে। কিন্তু আমেরিকা এসব উপেক্ষা করে।

ফলস্বরূপ, ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার অর্থনৈতিক (টুইন টাওয়ার), সামরিক (পেন্টাগন) ও রাজনৈতিক (ক্যাপিটাল হিল) সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ৩টি অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে আক্রমণ চালায় আল-কায়েদা। আর এই হামলার মাধ্যমে আমেরিকাকে আফগানের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে, ইরাকের মরু প্রান্তরে, আফ্রিকার দুই প্রান্তে এবং ইয়েমেনে আটকে তাদের শক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়, ফলে আমেরিকা আজ একক বিশ্বমোড়লের পদবি হারানোর দ্বারপ্রান্তে।

৯/১১ অভিযানের আগে আমেরিকা মুসলিমদের সাথে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে তেমনভাবে না আসলেও, পরোক্ষভাবে সে প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছে; যার শিকার হয়েছে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, সোমালিয়া, চেচনিয়া, বসনিয়াসহ বিশ্বের বহু মুসলিম দেশ। এতোগুলি রাষ্ট্রে আগ্রাসন চালানোর পরেও আমেরিকা বিশ্ববাসীর কাছে ছিলো ‘মানবতাবাদী ও জনদরদী’।

কিন্তু এই অভিযানের পর আমেরিকার কথিত মানবতাবাদী মুখোশ ধীরে ধীরে খসে পরতে শুরু করে। তবে, এটি ঠেকাতে প্রোপাগান্ডা ও মিডিয়া আগ্রাসন চালানোর ক্ষেত্রে আমেরিকা কোনো কমতি রাখেনি। আমেরিকা কথিত থিংকট্যাঙ্ক র‍্যান্ড-এর বিভিন্ন নথি ফাঁস হওয়ার পর এসব প্রোপাগান্ডা-ষড়যন্ত্রের অনেক অজানা বিষয় উঠে আসে বিশ্ববাসীর সামনে।

আমেরিকা শুধুমাত্র মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং, বিশ্বজুড়ে একের পর এক দেশে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে, পছন্দসই সরকার প্রতিষ্ঠা করতে গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে গোপনে অভিযান চালিয়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই দীর্ঘ নোংরা যুদ্ধে ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি আমেরিকার হাতে অন্তত ৩ কোটি নিরীহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। গ্লোবাল রিসার্চ: সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন-এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানানো হয়েছে, গত ৭৩ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এই গবেষণাটি কয়েক বছরের বিস্তারিত গবেষণার পর প্রস্তুত করেছেন মার্কিন ইতিহাসবিদ জেমস এ. লুকাস।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া অবৈধ যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ও গোপন অভিযানগুলোর শিকার হয়েছে বিশ্বের অন্তত ৩৭টি দেশ বা জাতি। এসব সংঘাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। মৃত্যুর পাশাপাশি, অগণিত মানুষ গুরুতর আহত হয়েছে। আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র এবং বিমান হামলার কারণে বহু মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধে প্রতি নিহত ব্যক্তির বিপরীতে অন্তত ১০ জন আহত হয়, যার মানে মার্কিন বাহিনীর হাতে আরও ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ আহত হয়েছে।

বর্তমানে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ শহীদ হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। পুরো ভূখণ্ড ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অথচ, এই বর্বরতাকেই ইসরায়েল ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ হিসেবে উপস্থাপন করে এবং আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব তাদের পাশে দাঁড়িয়ে এই সহিংসতা সমর্থন করছে।

অনেক মুসলিম মনে করেন, এই হামলা ছিল একটি ভুল পদক্ষেপ, যার কারণে আমেরিকা মুসলিম দেশগুলোতে হামলা চালিয়েছে। কিন্তু তারা ভুলে যান, মার্কিন আগ্রাসন ৯/১১ থেকে শুরু হয়নি। বরং, এ হামলাই ছিল মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে চলমান আগ্রাসনের প্রতিরোধে প্রথম কার্যকর সামরিক পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, সোমালিয়া, চেচনিয়া ও বসনিয়ায় যে আক্রমণ চলছিল—৯/১১ ছিল তার বিরুদ্ধে জবাব।


তথ্যসূত্র:
১। ইরাক যুদ্ধের আগে যে নিষেধাজ্ঞা দেশটিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল
– https://tinyurl.com/3ex2udcc
২। U.S. Regime Has Killed 20-30 Million People Since World War II
– https://tinyurl.com/4tvwacd3

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৯/১১; আমেরিকার উপর জুলুম নাকি তাদের পাপের শাস্তি?
পরবর্তী নিবন্ধঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ৯/১১ নিয়ে বিবৃতি : কমেন্টবক্সে বাংলাদেশের আপামর জনগণের মার্কিন আগ্রাসনবিরোধী ট্রল