
পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি ঘিরে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। জালজালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ, অস্বচ্ছতা, অনুমোদনবিহীন সিদ্ধান্ত, অতিরিক্ত ব্যয় এবং অর্থ ব্যবস্থাপনায় অসংগতির বিস্তারিত চিত্র সর্বশেষ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক চুক্তি অনুযায়ী রূপপুরে প্রতিটি এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি ইউনিট নির্মাণ করে মোট দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালের চূড়ান্ত চুক্তিতে প্রতিটি ইউনিটের সক্ষমতা বাড়িয়ে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট করা হয়। অর্থাৎ মোট উৎপাদন ধরা হয় দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
নিরীক্ষকদের অভিযোগ, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুমোদন কোথা থেকে এসেছে, কোন বৈঠকে বা কোন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে—এমন কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তাই উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি অস্বচ্ছ রয়ে গেছে।
সক্ষমতা বাড়ানোর এ সিদ্ধান্তের কারণে প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। প্রাথমিক অনুমান ছিল প্রায় ৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পরে খরচ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা। অথচ খরচ বাড়ানোর যৌক্তিকতা, আলোচনার প্রক্রিয়া কিংবা অনুমোদনের লিখিত প্রমাণ কোনো কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
২০১২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের সভাপতিত্বে বৈঠক করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণে একটি সমঝোতা দল গঠন করা হয়। এতে অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, বিদ্যুৎ বিভাগ ও পরমাণু শক্তি কমিশনের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা যুক্ত ছিল। তাদের দায়িত্ব ছিল রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে খরচ চূড়ান্ত করা। কিন্তু ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কোনো আলোচনার কার্যক্রমের নথি পাওয়া যায়নি। বরং ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর সরাসরি রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে ১২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়। এর আগে প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য আরো চারটি চুক্তি করা হয়েছিল, যার মূল্য ছিল প্রায় শূন্য দশমিক ৫৪৫৯ বিলিয়ন ডলার। ফলে মোট খরচ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে রোসাটমের সঙ্গে সব চুক্তির প্রধান মধ্যস্থতাকারী ছিল ড. জাহেদুল হাছান। প্রকল্প ব্যয়ের নেপথ্য হোতা হিসেবেও তার নাম এসেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, অতিরিক্ত পাঁচ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধির সিংহভাগ অর্থ তার মাধ্যমে লোপাট হয়েছে। ইতোমধ্যে তার দুর্নীতির বিষয়ে দুদক তদন্ত শুরু করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সমিতিও (ক্যাব) দুদকের কাছে ড. জাহেদুল হাছানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে।
প্রতিবেদনে জানা যায়, রাশিয়ার তিনটি শহরে যন্ত্রপাতি পরীক্ষার জন্য কোয়ালিটি ইন্সপেকশন ইউনিট ভাড়া করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারি নথিতে দেখা যায়, একই সময়ে ইন্সপেকশন টিমকে হোটেলে অবস্থান দেখিয়ে আলাদা ভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে। ২০১৭ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শুধু হোটেল খরচ দেখানো হয়েছে দুই কোটি ৭৯ লাখ টাকা। সিএজির প্রতিবেদনে এটিকে ‘অযৌক্তিক ব্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই সময় প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ছিল ড. জাহেদুল হাছান (বর্তমানে এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক)। তার নেতৃত্বেই এসব ব্যয় করা হয় বা দেখানো হয়।
অভিযোগ আছে, ড. জাহেদুল ও এবং তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ড. শওকত আকবরের নেতৃত্বে ও বিশেষ স্বার্থে ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই প্রকল্পের সক্ষমতা ও ব্যয় বাড়ানো হয়।
এছাড়া প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান (বর্তমানে এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক) রাশিয়ায় আবাসন ভাড়ার নামে ৭৭ লাখ টাকার বেশি নগদ অর্থ তুলেছে। অথচ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির নির্দেশনা ছিল, এসব খরচ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। নিয়ম ভেঙে সরাসরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে ব্যয় করা হয়। এ অর্থ যথাযথভাবে সমন্বয় হয়েছে কি না—সেটিরও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়ায় ভিভিআর-১২০০ প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে প্রতি কিলোওয়াটে খরচ হয় চার হাজার ৭৫ ডলার। অথচ রূপপুরে খরচ হচ্ছে পাঁচ হাজার ৮৯০ ডলার। একই প্রযুক্তিতে ফিনল্যান্ডে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ডলার আর তুরস্কের আক্কুইউ প্রকল্পে মাত্র তিন হাজার ২০০ ডলার। ফলে তুলনায় রূপপুর প্রকল্প উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যয়বহুল।
প্রকল্প ঘিরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)ও অনুসন্ধান শুরু করেছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয় ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে অতীতে রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতি নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম ও ঢাকায় রাশিয়ান দূতাবাস এ অভিযোগ অস্বীকার করে।
তথ্যসূত্র:
১. জাহেদুলের বিরুদ্ধে মিলল কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ
– https://tinyurl.com/59xu3ref


