মোদির সফর নিশ্চিত করতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একদিনে ১৬ জন ছাত্র-জনতাকে হত্যা আ.লীগ প্রশাসন

0
75

ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের সাড়ে ১৫ বছর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের কাছে দুঃসহ স্মৃতি। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর আগ পর্যন্ত জেলায় অন্তত ৩৬ জন বিরোধী দল-মতের মানুষ আওয়ামী লীগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন অগণিত মানুষ। বিশেষ করে রিমান্ডে নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে জামায়াত নেতার মৃত্যু রাজনৈতিক অঙ্গনে বড় ক্ষতের সৃষ্টি করে।

স্থানীয় সচেতন মানুষ ও রাজনৈতিক দলের ভুক্তভোগীরা গণমাধ্যমকে জানায়, দিনের পর দিন রাজনৈতিক মিথ্যা মামলার হুলিয়া নিয়ে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে বিরোধী শিবিরের অনেক নেতাকর্মীকে। অহেতুক কারাবরণ করিয়ে রিমান্ডের নামে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে অনেককে। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময় আলেম সমাজ ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের স্টিম রোলার।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাজনৈতিক সৌহার্দের অনন্য দৃষ্টান্ত ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তবে ২০০৯ সালের নির্বাচনে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জেলার রাজনীতির চিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। নিজস্ব ফায়দা হাসিলের জন্য বিরোধীদলীয় মত দমনে লাগামহীন হয়ে পড়ে আওয়ামী ক্যাডাররা। এর সঙ্গে প্রশাসনকে দলীয়করণের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয় জনগণের বিরুদ্ধে। সরকারের নেতিবাচক দিক নিয়ে কেউ কথা বললেই পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে হামলা, মামলা, দমন, নিপীড়ন, খুন সবই যেন ছিল মামুলি ব্যাপার।

শুধু তা-ই নয়, আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হিন্দুদের টার্গেট করে হামলা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর চালানো হতো নিপীড়ন। যার উদাহরণ ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরের সংসদ সদস্য (এমপি) এবং তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হককে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে এলাকার হিন্দু বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে। আর এই ষড়যন্ত্রের জন্য সায়েদুল হক সরাসরি উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগও এনেছে। সে সময় এ ঘটনায় জড়িত থাকায় গ্রেপ্তার করা হয় মোকতাদির চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহচর জেলা যুবলীগ নেতা ও হরিপুর ইউপি চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি।

হেফাজতে ইসলামের ওপর হত্যাযজ্ঞ : নিহত ১৬, আহত শতাধিক

২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালায় আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী প্রশাসন। নির্বিচারে ১৬ ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আহত ও পঙ্গুত্ব বরণ করে শতাধিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় এ ঘটনা ঘটে। কিন্তু ভারতে মসুলিম নিধনের সঙ্গে মোদির সম্পৃক্ততার কারণে তার আগমনে আপত্তি জানান শীর্ষ আলেম-ওলামারা। পরে ২৬ মার্চ বিক্ষোভের ডাক দেন হেফাজতে ইসলামে নেতাকর্মীসহ মাদরাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতা। এর জেরে ২৭ মার্চ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ তাদের নেতাকর্মীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরের কান্দিপাড়ায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় হামলা করে।

এ সময় মাদরাসা রক্ষায় স্থানীয় জনগণও মাঠে নেমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরে ২৭ ও ২৮ মার্চ পুরো জেলাজুড়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ সময় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জেলার বিভিন্ন পয়েন্টে বিক্ষোভ মিছিলে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। এতে ১৬ জন নিহত হন। পরে তাদের লাশ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য করা হয়। এ ঘটনায় পুরো দেশজুড়ে শোক নেমে আসে। এ বিষয়ে নিহতের পরিবার মামলা করতে চাইলেও নেয়নি পুলিশ। উল্টো জেলার বিভিন্ন থানায় আলেম-ওলামাসহ বিএনপি, জামায়াত ও ভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নামে ৫৫টি মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করা হয়।

পুলিশ-ছাত্রলীগ মিলে মাদরাসায় হামলা, ছাত্রকে গুলি করে খুন

২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে অটোরিকশা ভাড়া নিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক নেতার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। এর জেরে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মাদরাসাছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় পরিস্থিতি উত্তাল হলে পুলিশও মাদরাসাছাত্রদের ওপর আগ্রাসী হয়। এক পর্যায়ে মাদরাসাছাত্র হাফেজ মাসুদুর রহমান পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা

জেলায় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা। মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি মোকতাদির চৌধুরী রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে এই দাঙ্গার সৃষ্টি করে। ঘটনার সূত্রপাত ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের রসরাজ দাস নামে এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি থেকে পবিত্র কাবা শরিফের ওপর শিবমন্দিরের ছবি পোস্ট করা হয়।

এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকায় তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। স্থানীয়রা ওই যুবককে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। এরপরও তীব্র প্রতিবাদ অব্যাহত থাকে। কয়েকটি ইসলামি সংগঠন ও স্থানীয় মুসলমানরা পরদিন (৩০ অক্টোবর) প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দেয়। পৃথক দুটি প্রতিবাদ কর্মসূচিতে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। প্রতিবাদ কর্মসূচি চলাকালীন একদল লোক বহু হিন্দু বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর এবং লুটপাট চালায়।

ঘটনা ঘটার পরপরই সেই আসনের সংসদ সদস্য প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও তৎকালীন মৎস্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট ছায়েদুল হক সংবাদ সম্মেলন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরীকে এই হামলার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ করে। পরে ঘটনার তদন্তে নেমে মোকতাদিরের সহচর ও যুবলীগ নেতা আঁখিকে ঘটনার মূল হোতা হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। কিন্তু এসব মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি-জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর নেতাকর্মীদের। এখনো এসব মামলায় ভুগছেন তারা।

জুলাই বিপ্লবে নিহত ২৭ জন

আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসন-অপশাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে গর্জে উঠেছিল ছাত্র-জনতা। তারা অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দেশকে মুক্ত করেছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন থেকে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্তত ২৭ জন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। এর মধ্যে মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের নাম সবার কাছেই পরিচিত। তিনি শহরের কাজীপাড়া এলাকার মোস্তাফিজুর রহমান বাবুলের ছেলে। এ ছাড়া অন্যান্য শহীদের মধ্যে রয়েছেন সদর উপজেলার বড়িশ্বল গ্রামের হোসেন (১২), নাসিরনগরের গোয়ালনগর গ্রামের মো. ইমরান (১৯), সরাইলের বারপাইকা গ্রামের জসীম মিয়া (৩৫), মলাইশ গ্রামের মোবারক হোসেন (১৩), ফহেতপুর গ্রামের হাফেজ মুফতি মাহমুদুল হাসান মাহদী (২৬), তেলিকান্দা গ্রামের মো. রায়হান উদ্দিন (১৯), বিজয়নগরের পত্তন গ্রামের ওমর (২০), নবীরগরের ভিটি বিশার গ্রামের ছাত্র জাহিদুজ্জামান তানভীর (২৬), থোল্লাকান্দি গ্রামের রফিক (১৮), গৌরনগর গ্রামের কামরুল ইসলাম (১৭), বিটঘর গ্রামের তানজিল মাহমুদ সুজন (১৯), নবীনগর পৌরসভার গোলাম নাফিজ (১৬), বাঞ্ছারামপুরের নতুনহাটি গ্রামের ইসমাইল (৫০), সোনারামপুর গ্রামের তুহিন (২৫), ছয়ফুল্লাকান্দি গ্রামের জিসান, ফরদাবাদ গ্রামের ইমরান (২১), দড়িকান্দি গ্রামের আশিকুর রহমান প্রমুখ।


তথ্যসূত্র:
১. মোদির সফর নির্বিঘ্ন করতে ১৬ জনকে হত্যা
– https://tinyurl.com/495c62b4

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধচাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে নারী ও শিশুসহ আরও ১৯ জনকে পুশইন করলো বিএসএফ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাথমিকে গানের শিক্ষক নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিল করতে হবে এবং ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে: আহলে হাদীস বাংলাদেশ