
গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১৩ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। নৃশংস এই ঘটনায় অভিযুক্ত জয় কুমার দাস ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এরই মধ্যে গত ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত একটি বিবৃতি নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
পুলিশের ওই পোস্টে দাবি করা হয়, মেয়েটির সঙ্গে অভিযুক্ত যুবক জয় কুমার দাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং সে পূর্বে দু’বার পালিয়ে গিয়ে স্বেচ্ছায় ফিরে আসে। তবে মেয়েটির পরিবার জানিয়েছে, এসব তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ধর্ষণের ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার একটি চেষ্টা।
ভুক্তভোগী পরিবারটি জানায়, ঘটনার পর প্রায় দুই মাস মামলা গ্রহণে গড়িমসি করা হয়েছে এবং গত ১৮ অক্টোবর রাতে পুলিশ তাদের সাদা কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর নিতে বাধ্য করেছে। এছাড়া, তদন্তকারী কর্মকর্তা তাকে ফোন করে বলেছেন, সাক্ষাৎকারে শেখানো প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশের এই ভূমিকা দণ্ডবিধির ১৫৪ ধারা অনুযায়ী ভুক্তভোগীর ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন এবং এটি দায়িত্বে অবহেলার শামিল।
পুলিশের বিবৃতিতে বলা হয়েছিল— ‘গাজীপুরে হিন্দু যুবক কর্তৃক মাদ্রাসা ছাত্রী ধর্ষণ সংক্রান্তে একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এ সংক্রান্তে প্রকৃত তথ্য হলো- গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার আমিনুল ইসলাম এর ১৩ বছর বয়সী মেয়ের সাথে উক্ত এলাকার জয় কুমার দাসের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মেয়েটি ইতিপূর্বে দুইবার জয় কুমার দাসের সাথে পালিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় ফিরে আসে। গত ২০ আগস্ট মেয়েটি পুনরায় ওই যুবকের সাথে পালিয়ে যায় এবং ২ দিন পর বাসায় ফিরে আসে। গত ১৫ অক্টোবর মেয়ের মা মোছা: শিউলি বেগম তিনজনকে আসামী করে কালিয়াকৈর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পুলিশ মামলার আসামী জয় কুমার দাস ও তার অপর সহযোগী লোকনাথ চন্দ্র দাসকে গ্রেফতার করেছে। তদন্ত চলমান। এই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য বয়ানে প্রকাশ করায় বিভ্রান্তি তৈরী হচ্ছে। ঘটনাটিতে কোন সাম্প্রদায়িক সংশ্লেষ নাই।’
তবে প্রশাসনের এই বক্তব্যে আইনি এবং নৈতিক উভয় দিক থেকেই গুরুতর ত্রুটি ও মিথ্যা ন্যারেটিভ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) অনুযায়ী, ১৬ বছরের নিচে কোনো শিশুর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ‘সম্মতিতেও’ ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়। তাই ১৩ বছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে ‘প্রেমের সম্পর্ক’ বা ‘স্বেচ্ছায় পালানো’ এই ভাষা ব্যবহার করা আইনের অপব্যাখ্যা এবং ভিকটিম-ব্লেমিংয়ের উদাহরণ।
অনেকেই বলছেন, পুলিশের বক্তব্যের ভাষা শুধু আইনি ভুল নয়, এতে একটি গভীর সামাজিক পক্ষপাত কাজ করছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় মেয়েটির প্রতি যে সংবেদনশীলতা থাকা প্রয়োজন ছিল, তা অনুপস্থিত। বরং ঘটনাটিকে ‘প্রেমঘটিত’ আখ্যা দিয়ে অপরাধের গুরুত্ব খাটো করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে, যা ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতি অবমাননাকর।
এছাড়া, ঘটনাটির প্রায় দুই মাস মামলা গ্রহণে গড়িমসি করা হয়েছে এবং এটি পুলিশের প্রাথমিক দায়িত্ব লঙ্ঘন। কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউরের ১৫৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ভিকটিমের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।
পুলিশের বক্তব্যে ঘটনাটির মানসিক ও সামাজিক মাত্রাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে। একজন নাবালিকা মেয়েকে আটকে রেখে একাধিক ব্যক্তি মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন চালানো, ভয়ভীতি দেখানো এসবই পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৩৪০ এবং ৫০৬ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ‘প্রেমের সম্পর্ক’ অথবা ‘স্বেচ্ছায় পালানো’ বলে এসব অপরাধের বৈধতা দেওয়া যায় না।
এ ধরনের দায়সারা মন্তব্য শুধু ভিকটিম পরিবারকে অপমান করে না, বরং পুলিশের নৈতিক দায়িত্ববোধ এবং নিরপেক্ষ তদন্তের প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
উল্লেখ্য, গত দুই মাস আগে, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের মৌচাক এলাকায় ১৩ বছর বয়সী এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে মাদ্রাসায় যাওয়ার পথে পরিকল্পিতভাবে অপহরণ করে একদল হিন্দুত্ববাদী চক্র। এরপর ওই চক্রটি মুসলিম শিক্ষার্থীকে তিন দিন একটি বাসায় আটকে রেখে যৌন নির্যাতন চালায়। হিন্দু চক্রটির পাশবিক নির্যাতনের ফলে ঘটনার দুই মাস পরেও শিশুটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ।
তথ্যসূত্র:
1. https://tinyurl.com/2mmd55ac


