তুরস্কে শান্তিচুক্তি আলোচনায় ব্যর্থতা এবং টিটিপি উত্থানের দায় পাকিস্তানের কিছু সামরিক নেতৃত্বের: জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ

0
326

ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের মুখপাত্র মৌলভী জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ ৮ নভেম্বর তুরস্কে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক শান্তিচুক্তি আলোচনা, পাকিস্তানে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) এর উত্থান এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে বিস্তারিত বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, পাকিস্তানের কিছু সামরিক নেতৃত্ব আফগানিস্তানে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে মনে করে। বহু বছর ধরে তারা আফগানিস্তানের অস্থিরতা, যুদ্ধ এবং উদ্বাস্তু সংকটের সুযোগ নিয়েছে এবং এবারও মিথ্যা অজুহাত তুলে উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।

মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ বলেন, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের উক্ত আফগান-বিরোধী নীতির প্রতি সেদেশের ধার্মিক জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং সম্মানিত ওলামা মাশায়েখদের সমর্থন নেই। এদিকে কিছু গোষ্ঠী মিথ্যা অভিযোগ করে বলছে যে, পাকিস্তানের অস্থিরতা এবং টিটিপির উত্থান ইমারাতের ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে, এই অস্থিরতা এবং টিটিপির উদ্ভব ২০০২ সাল থেকেই, যা পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের ভুল নীতির ফল। সেসময় থেকেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে ওয়াজিরিস্তানের স্থানীয় জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান এবং ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে, যাতে বহু নিরীহ বেসামরিক নাগরিক ্নিহত হয়, বাড়িঘর ধ্বংস হয় এবং বহু নিরপরাধ উপজাতীয় বাসিন্দাদের কারারুদ্ধ করা হয়।

জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ আরও বলেন, টিটিপির উত্থানের সাথে ইমারতের কোনো যোগসূত্র নেই— এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে পশতুন উপজাতিদের পুরনো সংঘর্ষের ফল। ২০০২ সালে টিটিপি গড়ে ওঠে পাকিস্তানের (সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে) যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা এবং ওয়াজিরিস্তানে হামলার প্রতিক্রিয়ায়। তারপর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী টিটিপির বিরুদ্ধে সামরিক অপারেশন চালিয়েছে, একই সময়ে গোষ্ঠীটিও পাকিস্তান জুড়ে ছোট-বড় হামলা চালিয়েছে।

উক্ত বক্তব্যে জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ টিটিপির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পুরনো কিছু বড় বড় সামরিক অপারেশনের উদাহরণ তুলে ধরেন, যা নিম্নে উল্লেখ করা হল-

অপারেশনের নামঃ অপারেশন আল-মিজান
সময়কালঃ ২০০২ সালের মার্চ মাস
স্থানঃ দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান, উত্তর ওয়াজিরিস্তান এবং ওরাকজাই এজেন্সি
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ৮০,০০০ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন রাহ-ই-রাস্ত
সময়কালঃ ২০০৭ সাল
স্থানঃ সোয়াত এবং মালাকান্দ
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ৪ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু। যাদের অনেকেই আফগান সীমান্তে আশ্রয় নিয়েছে।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন শের দিল
সময়কালঃ ২০০৮ সাল
স্থানঃ বাজৌর এজেন্সি
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ৬ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন নিজাত
সময়কালঃ ২০০৯ সালের অক্টোবর
স্থানঃ দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ৩-৪ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন কোহ-ই-সাফিদ
সময়কালঃ ২০১১ সালের জুলাই
স্থানঃ কুররাম এজেন্সি
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ১ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন যারব-ই-আযাব
সময়কালঃ ২০১৪ সালের ১৫ জুন
স্থানঃ উত্তর ওয়াজিরিস্তান
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ১০ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু, যার অর্ধেকই আফগানিস্তানে।

অপারেশনের নামঃ অপারেশন খাইবার (এক থেকে চার)
সময়কালঃ ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল
স্থানঃ তিরাহ, বারা উপত্যকা
সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিঃ ৩-৫ লক্ষ স্থানীয় বাসিন্দা উদ্বাস্তু, অধিকাংশই আফগানিস্তানের নাঙ্গারহারে।

এই সামরিক অপারেশনগুলোর আগেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পশতুন উপজাতি এবং টিটিপির সাথে লড়াই করেছে। আর তারা এটা স্বীকারও করেছে যে, (কথিত) সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ৮০-৯০ হাজার সেনা ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ ইমারতে ইসলামিয়া প্রশাসন ক্ষমতায় আসার আগে টিটিপি কর্তৃক পাকিস্তানে বড় কিছু হামলার উদাহরণও তুলে ধরেন,

– ২০০৭ সালের আগস্ট: টিটিপি দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে ৩০০ পাকিস্তানি সৈন্যকে বন্দী করে।
– ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট: পাঞ্জাবে অস্ত্র কারখানায় হামলা।
– ২০০৮ সালের ২ জুন: ইসলামাবাদে ডেনিশ দূতাবাসে গাড়ি বোমা হামলা।
– ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর: পেশোয়ারে মেনা বাজারে গাড়ি বোমা হামলা।
– ২০০৯ সালের অক্টোবর: সোয়াতের শাঙ্গলা বাজারে গাড়ি বোমা হামলা – ৪৭ জন মৃত।
– ২০১১ সালের ২২-২৩ মে: করাচির নৌবাহিনী ঘাঁটি (পিএনএস মেহরান) হামলা – ১৮ নৌসেনা মৃত।
– ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর: পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুল (এপিএস) হামলা – ১৫০ জন মৃত, ১৩৪ আহত।

এই হামলাগুলো দেখায় যে, পাকিস্তানের অস্থিরতা ইমারতে ইসলামিয়ার কারণে নয়, বরং এটি তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা।

বিপরীত দিকে, ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় গ্রহণের পর হতে, পাকিস্তানের অস্থিরতা দূরীকরণ এবং উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে ইমারতে ইসলামিয়া কর্তৃক গৃহীত উল্লেখযোগ্য কিছু পদক্ষেপ তুলে ধরেন জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ,

– পাকিস্তান থেকে আগত রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতৃত্বের সাথে আফগানিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তানী উদ্বাস্তুদের মধ্যে বৈঠক ও সংলাপের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
– ডুরান্ড লাইনের কাছে থাকা উপজাতীয় উদ্বাস্তুদের আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় এলাকায় স্থানান্তর করে সংগঠিত ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। কারণ, তাদের ডুরান্ড লাইনের কাছে অবস্থানের কারণে পাকিস্তান নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করে আসছিল।
– উদ্বাস্তুদের মধ্যে অস্ত্র বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
– সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, এবং বিবাদ নিরসনের কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
– আমীরের অনুমতি ছাড়া বিদেশে জিহাদে যাওয়া ধর্মীয় আইন (ফতোয়া জারি) করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
– মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তান সরকার ও টিটিপির মধ্যে সরাসরি বৈঠক ও সংলাপ চালু করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হয়েছে, যার ফলে উভয়পক্ষ দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের একটা ক্ষুদ্র অংশ এটিকে বিনষ্ট করেছে।

জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ হাফিযাহুল্লাহ আরও বলেন, বর্তমানে আফগানিস্তানে থাকা উপজাতীয় উদ্বাস্তুরা ইমারতে ইসলামিয়া ক্ষমতা গ্রহণের আগে এসেছে, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের একটা ক্ষুদ্র অংশের ভ্রষ্ট নীতি এবং উপজাতীয় এলাকায় নির্বিচারে সামরিক অভিযানের কারণে। ইমারত তাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নেওয়ার যেকোনো প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায়।

একই সময়ে, এই সমস্ত পদক্ষেপ সত্ত্বেও, ইমারতে ইসলামিয়া এটি নিশ্চিত করার জন্য নিজেকে দায়িত্বশীল মনে করে যে, কেউ যেন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য তাদের ভূমি ব্যবহার না করে এবং এ জাতীয় কর্মকাণ্ড রোধ করার জন্য ইমারত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, ইনশাআল্লাহ।


তথ্যসূত্র:
– https://tinyurl.com/49e3w8zy

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিডিও || মধ্যপ্রদেশে ১২ মুসলিমের বাড়ী ও দোকান গুঁড়িয়ে দিল হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন
পরবর্তী নিবন্ধমোগাদিশুর উপকণ্ঠে আশ-শাবাব মুজাহিদদের হামলা অব্যাহত: হতাহত অসংখ্য শত্রু সেনা