
“আশ-শাবাবের হামলাগুলো আমাদের আকস্মিক বন্যার মতো গ্রাস করেছে, যা সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। শাবাবের এসকল আক্রমণে আমরা ১৫,০০০ সৈন্য ও অধিকাংশ সিনিয়র কমান্ডারদের হারিয়ে প্রাণশক্তি ও যোগ্য নেতৃত্বশূন্য সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়েছি।”। সম্প্রতি এক সংসদীয় অধিবেশনে এমনটাই মন্তব্য করেছে সোমালিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও কমান্ডার-ইন-চিফ।
২০২২ সাল থেকে প্রায় তিন বছর পর, সোমালি রাষ্ট্রপতি হাসান শেখ মাহমুদ (গুরগুরতে) নিজেকে একটি ভয়াবহ সামরিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে আবিষ্কার করেছে। হাসান মাহমুদ শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে স্পষ্ট পরিকল্পনা ও পরিণতির মূল্যায়ন ছাড়াই তার সরকারকে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে। এটি এমন একটি যুদ্ধ ছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি নির্দেশে পরিচালিত হয়েছিল এবং এটি জাতীয় স্বার্থের বিপরীতে খুবই বাজে কৌশলের একটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ ছিলো।
হাসান শেখের মোগাদিশু সরকার আফ্রিকান ইউনিয়ন সেনাবাহিনীর সাহায্যে এবং আমেরিকা ও তুরস্ক থেকে বিমান সহায়তা নিয়ে হিরান, জালাজদুদ এবং মুদুগ প্রদেশে তার সৈন্যদের ব্যাপকহারে মোতায়েন করেছিল। কিন্তু আশ-শাবাবের তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হওয়ার পরে এই বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যার ফলে এলাকা পুনর্দখলের পরিবর্তে কয়েক ডজন সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারায় মোগাদিশু বাহিনী।
হারাকাতুশ শাবাব মুজাহিদিনরা ২০২৫ সালের শুরু থেকে বেশ কয়েকটি ক্লিন সুইপ আক্রমণ শুরু করেন, যা বিভিন্ন প্রদেশে সোমালি সেনাবাহিনী এবং এর জোটের উপস্থিতি শেষ করে দেয়। এরমধ্যে আসোইনের যুদ্ধ ছিল এই যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়, যা ধারাবাহিক পরাজয় এবং বিভিন্ন এলাকায় মোগাদিশু বাহিনীর পতনের দরজা খুলে দিয়েছিল।
২০২২, ২০২৩ এবং ২০২৪ সালের যুদ্ধগুলোতেও শাবাব মুজাহিদদের তীব্র আক্রমণে মোগাদিশু বাহিনী ব্যাপক হতাহত এবং বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এরপর ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে (রমজান মাস) আশ-শাবাব মুজাহিদিনরা একটি বৃহৎ আকারের পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন, যা মোগাদিশু সরকারকে অভূতপূর্ব বিভ্রান্তি এবং হতাশার মধ্যে ফেলে দেয়।
এই অপারেশনগুলির ফলে, আশ-শাবাব মুজাহিদিনরা মধ্য শাবেলি, নিম্ন শাবেলি এবং হিরান রাজ্য থেকে শুরু করে জালাজদুদ রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল এমনকি রাজধানী মোগাদিশুর উপকন্ঠে বালআদ শহরে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। এসময় রাজধানী মোগাদিশুর বিভিন্ন এলাকায় শাবাবের উপস্থিতি এবং ঘনঘন তীব্র আক্রমণগুলো মোগাদিশু সরকারের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ ও ভয়ের কারণ হয়ে উঠে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি সংসদীয় অধিবেশনে, সোমালিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আহমেদ মুয়ালিম ফিকি এবং সোমালিয়ার সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ জেনারেল উদাওয়া ইউসুফ রাগে সিনেটের সামনে উপস্থিত হয়। এসময় তারা ক্লান্ত ও হতাশায় নিমজ্জিত মুখ নিয়ে, হারাকাতুশ শাবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সর্বশেষ উন্নয়ন সম্পর্কে কথা বলে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছে যে, হারাকাতুশ শাবাব মুজাহিদিনরা সোমালি সামরিক বাহিনীকে একটি আকস্মিক বন্যার প্রচণ্ড স্রোতের মতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে… এবং এখন বিশ্ব সোমালিয়াকে নতুন আফগানিস্তান হিসাবে দেখছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুয়ালিম ফিকি স্বীকার করেছে যে, শাবাবের সাম্প্রতিক আক্রমণগুলো একটি আকস্মিক বন্যার মত ছিল, যা সেনাবাহিনীকে প্রচণ্ড স্রোতের মাঝে ডুবিয়ে দিয়েছে। এই মন্ত্রী আরো জোর দিয়ে বলেছে যে, আশ-শাবাব এখন এমন একটি শক্তিতে পরিণত হয়েছে, যাকে হালকাভাবে নেওয়া যায় না। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সোমালিয়াকে আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে দেখছে, যেখানে তালিবানরা দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর একটি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে।
এই মন্ত্রী আরও যোগ করেছে যে, মোগাদিশু সেনাবাহিনী “আর নিজেদের আত্মরক্ষা করতেও সক্ষম নয়, পাল্টা আক্রমণ চালানো তো দূরের কথা”। সৈন্যদের মনোবল ভেঙে পড়ার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি সবাইকে সৎ ও নৈতিক হতে বলেন। কেননা ইতিমধ্যে “বিদেশী সমর্থকরা এই যুদ্ধের ব্যয় বহন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে”। যখন পূর্ব আফ্রিকা জুড়ে আশ-শাবাবের কার্যক্রম বিস্তৃত হচ্ছে, তখন মালিতে জামাআত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন একের পর এক সাফল্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তার বক্তব্য অব্যাহত রেখে আরও বলেছে, সোমালিয়া সেনাবাহিনীর কাছে প্রচুর পরিমাণে সম্পদের অভাব রয়েছে। অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও সীমিত গোলাবারুদ নিয়ে কোন স্পষ্ট কৌশল ছাড়াই সেনাবাহিনী যুদ্ধ করছে।
সেনাপ্রধান: “আমরা ১৫,০০০ সৈন্য হারিয়েছি… এবং আমাদের ফ্রন্ট লাইন সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।”
সোমালি সেনাবাহিনীর চিফ অফ স্টাফ (সেনাপ্রধান) জেনারেল উদাওয়া ইউসুফ রাগে এক বিস্ময়কর স্বীকারোক্তিতে সামরিক বিপর্যয়ের পরিমাণ প্রকাশ করে নিশ্চিত করেছে যে, এই যুদ্ধে শাবাব মুজাহিদদের আক্রমণে তারা ১৫,০০০ এরও বেশি সৈন্য হারিয়েছে। আর আশ-শাবাব পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে বিশাল অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে।
সেনাপ্রধান স্বীকার করেছে যে অনেক ফিল্ড কমান্ডার তাদের পোস্ট ছেড়ে পালিয়ে গেছে এবং বেশিরভাগ সিনিয়র কমান্ডার যুদ্ধক্ষেত্রে শাবাবের আক্রমণে নিহত হয়েছে। সেনাবাহিনীতে এখন দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অফিসারের অভাব রয়েছে। ফলে সরকারকে বিদেশী প্রশিক্ষণের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে যা জাতীয় লক্ষ্য পূরণ করে না। কেননা আমেরিকা ও তুরস্ক এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশগুলো শুধুমাত্র সোমালিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়েই চিন্তা করে। তাই সরকারকে এই দেশগুলোর উপর নির্ভর না করার উপায় বের করা উচিত।
জেনারেল উপসংহারে বলেছে, “আমাদের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ার মুখোমুখি… গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেছে, চিকিৎসা সরবরাহ প্রায় নেই বললেই চলে, এবং সৈন্যরা আশা বা নেতৃত্বহীন। আহত সৈন্যদের একদিনের জন্যও চিকিৎসা করার সামর্থ্য আমাদের নেই।”
গত তিন বছর ধরে, সোমালিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র দেখেছে কিভাবে আশ-শাবাবের মারাত্মক আক্রমণাত্মক কৌশল সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছে। পাশাপাশি সোমালিয়ার সরকার এবং তার সহযোগীদের সামরিক শক্তিকে চূর্ণ করে দিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে, এই দীর্ঘ যুদ্ধ ফেডারেল সরকার এবং তার মিত্রদের একটি তিক্ত শিক্ষা দিয়েছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে আশ-শাবাব আন্দোলন এমন কোনও শক্তি নয় যা সহজেই ভেঙে ফেলা বা নির্মূল করা যায়।
এই বিলম্বিত উপলব্ধির ফলে ধারাবাহিক পরাজয়ের পর সরকারি শিবিরের উভয় পক্ষের মধ্যে অভিযোগ বিনিময় শুরু হয়েছে। হাসান মাহমুদ ২০১২ সালে সোমালিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে সে পূর্ব আফ্রিকার আল-কায়েদার ক্ষমতা ধ্বংস করার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ছিল, সে হারাকাতুশ শাবাব শাসিত অঞ্চলগুলি পুনরায় পাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। তখন সরকারের পরিকল্পনার মূল বিষয় ছিল জালাজদুদ এবং মধ্য শাবেলি রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা। কিন্তু আজ, দৃশ্যপট সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়েছে, এখন সোমালি জনগণের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হল: “আশ-শাবাব কখন রাজধানী মোগাদিশুর নিয়ন্ত্রণ নেবে বা চূড়ান্ত আক্রমণ আরম্ভ করবে?”
তথ্যসূত্র:
– https://tinyurl.com/zerwbhj7


