
ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মুসল্লির সমাবেশে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়ত মহাসম্মেলন। গত ১৫ নভেম্বর খতমে নবুয়ত সংরক্ষণ কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক মহাসম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন দেশের শীর্ষ আলেম আল্লামা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর হাফিযাহুল্লাহ। সম্মেলনে অংশ নেন পাকিস্তান, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আলেম-উলামা।
সম্মেলনে বক্তারা এক কণ্ঠে ঘোষণা দেন হযরত মুহাম্মদ ﷺ–এর পরে আর কোনো নবী নেই, এ আকিদা সুরক্ষা করা প্রতিটি মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব। বক্তারা কাদিয়ানী সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার জোরালো দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, এ বিষয়ে কোনো সমঝোতার সুযোগ নেই।
হেফাজতে ইসলামের আমির মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও বহু মুসলিম রাষ্ট্র ইতোমধ্যে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করেছে। মুসলিমদের ঈমান রক্ষায় বাংলাদেশেও একই সিদ্ধান্ত নেওয়া অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার অন্যতম দফা হচ্ছে—কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা। কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করার বিষয়ে সরকারের প্রতি আমরা দৃঢ় দাবি জানাচ্ছি। এ দাবির কোনো বিকল্প আমরা চাই না। খতমে নবুয়তের আকিদার ব্যাপারে কোনো ছাড় নয়।’
তিনি ইসলামি জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে সরকারের প্রতি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানান।
পাকিস্তান উলামায়ে জমিয়তের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান হাফিযাহুল্লাহ বলেন, ‘খতমে নবুয়ত উম্মাহর সম্মিলিত ইস্যু, কোনো দেশের সীমাবদ্ধ বিষয় নয়’। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে উম্মাহর ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বাংলাদেশ–পাকিস্তানের মুসলিমদের এক আকিদা, এক শক্তিতে আবদ্ধ।’
তিনি যোগ করেন, তাহরীক-এ-তাহাফ্ফুযে খতমে নবুওয়ত কোনো বিভেদ নয়; বরং উম্মাহর ঐক্য ও আকিদা রক্ষার আন্দোলন। পাকিস্তানের ওলামায়ে কেরাম এখানে শুধু উপস্থিতি জানাতে আসেননি—বরং তারা একটি পয়গাম নিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের মুসলিমদের জন্য। আর এখান থেকে আমি পয়গাম নিয়ে যেতে চাই পাকিস্তানের মুসলিমদের কাছে।
মাওলানা ফজলুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মুসলমান—দুই দেশের হলেও এক আকিদা, এক শক্তি। আজকের এই খতমে নবুয়ত মহাসমাবেশ দুই দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সম্পর্ক ও সহযোগিতার বন্ধন আরও শক্তিশালী করবে। মোহাব্বতের এই সম্পর্ক ইনশাআল্লাহ আরও গভীর হবে।
সম্মিলিত খতমে নবুওয়াত পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল হামিদ পীর সাহেব বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আলেমদের উপস্থিতি খতমে নবুয়তের আকিদাকে আরও শক্তিশালী করেছে। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘নবীর পরে কোনো নবী নেই; হেদায়াতের বিপরীতে কোনো নতুন পথ নেই; আর বাতিলের সাথে কোনো আপস নেই।’
তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে বলেন, ক্ষমতায় এলে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হবে—অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন হবে।
জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আব্দুল মালেক হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, কাদিয়ানী সম্প্রদায় ইসলামের গণ্ডির ভেতর ৭২ ফেরকার নয়, বরং তারা ইসলামের গণ্ডির বাহিরে। তাদের এ পরিচয়েই চলতে হবে। রাষ্ট্রকে সে ঘোষণাই দিতে হবে।
তিনি বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঈমানী বিষয়কে কেন্দ্র করে আজ সবাই একত্রিত হয়েছেন। কিছু মানুষ এই বিষয়েও অস্পষ্টতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে, কেউ কেউ নিজেই ধোঁকার মধ্যে পড়ে অন্যদের ধোঁকা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, এটিকে কিছু লোক ‘মাজহাবের ইখতেলাফ’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়— যা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। ‘কাদিয়ানী তো মাজহাবের ভিন্নতা নয়; তারা ইসলামের গণ্ডির বাইরের একটি দল। অতএব এটাকে মাজহাব বা ফিরকার ইখতেলাফ বলা যাবে না। বিষয়টিতে স্পষ্ট থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশে অনেক অমুসলিম আছে এবং তারা তাদের পরিচয় নিয়ে বাস করছে, কিন্তু কাদিয়ানীরা এ দেশে থাকলেও মুসলিম পরিচয়ে থাকতে পারবে না। ‘প্রশাসন এ কথা বোঝে না— এমন নয়। তাদের করণীয় হলো ইসলামের পরিচয় রক্ষা করা এবং এ বিষয়ে নিজেদের ঈমানি অবস্থান সুস্পষ্ট করা।’
মুফতি আব্দুল মালেক আরও বলেন, ‘সাংবাদিকদের দায়িত্ব হলো কোনো ধোঁকার আশ্রয় না নেওয়া এবং ইসলামের সঠিক অবস্থান জনগণের সামনে তুলে ধরা।’ পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে কাদিয়ানীদের পণ্য ও ব্যবসা বয়কট করা উচিত।’
তিনি আরও উল্লেখ করেন, আলেম-ওলামাদের এ বিষয়ে বসিরাতের (আলোচনা-সমালোচনা) মাধ্যমে, গবেষণাভিত্তিকভাবে স্পষ্ট বক্তব্য জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে।
মুতাকাল্লিমে ইসলাম, তরজুমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস গুম্মান (পাকিস্তান) হাফিযাহুল্লাহ বলেছেন, ‘কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করতে হলে আলেমদের সংসদে যেতে হবে।’
সৈয়দ আতাউল্লাহ শাহ বুখারীর নাতি, প্রসিদ্ধ আলেম সাইয়েদ কাফিল বুখারী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, ‘মহানবী ﷺ সর্বশেষ নবী—এ বিশ্বাসই ইসলামের ভিত্তি। কাদিয়ানী ফেতনা পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ পুরা অঞ্চলে ব্যাপক আলোচনার বিষয়।’ তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ কাদিয়ানী মতবাদের বিপক্ষে সমন্বিত অবস্থানে রয়েছে।
তাহরীকে খতমে নবুওয়তের আমির মুফতি ড. সাইয়্যেদ এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী হাফিযাহুল্লাহ বলেন, নবুওয়তের দরজা চিরতরে বন্ধ—এটাই ইসলামের চূড়ান্ত শিক্ষা।
তিনি আরও বলেন, ‘সেক্যুলার রাজনীতির নামে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা হয় না। অথচ দেশের প্রকৃত মালিক মুসলিমরা। তাদের দাবি সংবিধানে প্রতিফলিত না হলে সেই সংবিধান মানা হবে না।’
দেশের শীর্ষ মুফতি আল্লামা মিজানুর রহমান সাঈদ হাফিযাহুল্লাহ বলেন, ‘কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা বিশ্বব্যাপী হয়েছে। এখন করণীয়—বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঘোষণা নিশ্চিত করা।’ তিনি আরও বলেন, যদি সরকার জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ না করে, তাহলে ঈমানদার যুবকরা প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত।
এছাড়াও সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা এবং দেশ-বিদেশের শীর্ষ আলেম-ওলামা বক্তব্য রাখেন। এ সময় ক্ষমতায় গেলে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণার দাবি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা।
মহাসম্মেলন থেকে কাদিয়ানীদের ইসলাম ও মুসলিম পরিচয় বন্ধ, তাদের সব বিতর্কিত ও ইসলামবিরোধী প্রচারণা নিষিদ্ধ সহ ছয় দফা ঘোষণা করা হয়। এটি পেশ করেন-বেফাক মহাসচিব মাওলানা মাহফুজুল হক হাফিযাহুল্লাহ। এই ছয় দফা অনতিবিলম্বে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার জন্য বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান।
কাদিয়ানিদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে তিন দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-
আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বস্তরের আলেম-উলামা ও তাওহিদি জনতার অংশগ্রহণে গণস্বাক্ষর; মে ও জুন মাস জুড়ে দেশের প্রতিটি জেলায় দায়িত্বরত জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর স্মারকলিপি প্রদান; জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশের প্রতিটি বিভাগে পর্যায়ক্রমে বিভাগীয় খতমে নবুওয়ত সম্মেলন আয়োজন করা হবে।
এইসব শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করার পরও যদি কাদিয়ানি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম সংখ্যালঘু ঘোষণা করার ন্যায়সঙ্গত দাবি সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত না হয়, তবে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যে দেশের প্রতিনিধিত্বশীল শীর্ষ উলামায়ে কেরামকে নিয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন আহ্বান করা হবে।
তথ্যসূত্র:
১. কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের দাবি তীব্রতর
– https://tinyurl.com/yrsxv9en


