মানবতা! একটি গুণ, একটি অনুভূতি, বর্তমানে যা মানবসভ্যতা থেকে বিলুপ্ত প্রায়, আছে কেবল একটি শব্দরূপে! তবে, আজ শব্দটির রূপ পাল্টেছে, পাল্টে গেছে এর ব্যবহার। ‘মানবসভ্যতা’র উপর হামলাকারীরা পেয়েছে ‘মানবতাবাদী’র খেতাব, আর নিজ ধর্ম ও ভূমি রক্ষার প্রচেষ্টাকারী জাতি আখ্যায়িত হয়েছে ‘জঙ্গীবাদী’, ‘সন্ত্রাসবাদী’সহ আরো অনেক উপাধীতে!
এখন সিরিয়ার কথা বলি। কী বলবো? আজ যে তা এক বিরানভূমিতে পরিণত হতে চলেছে! সেখানে আছে একটি রক্তাক্ত ভূখণ্ড, যা তার অধিবাসীদের রক্তমেখে রঙ্গিন হয়েছে। সেখানে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন বাজারের চিহ্ন, আছে বিধ্বস্ত কিছু বাড়িঘর যার ভেতর থেকে আসা চাপা কান্নার আওয়াজ চারদিক ভারী করে তুলেছে!
সেখানে হয়তো পর্দাবৃত কোন মা-বোন ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে খাবার খুঁজছে রাস্তার পাশের কোন নর্দমায়। আবার, হতে পারে স্বজন হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া কোন মানবকে আপনি খুঁজে পাবেন সিরিয়ার কোন রাস্তায়, কোন হাসপাতালের বারান্দায়! কিন্তু, হাসপাতালগুলোও তো রেহাই পায়না, রেহাই নেই মুসলিম নামক জাতির সেবাকারী কোন মানবেরই! তবুও, আপনাকে মেনে নিতে হবে যে, এগুলোই হলো ‘মানবতা’! এসকল কর্ম সম্পাদনকারী গোষ্ঠীরাই হলো ‘মানবতাবাদী’! আর, যারা এটা মানবে না বা মানছে না, তারাই হলো সন্ত্রাসী, জঙ্গীবাদী,উগ্রবাদী ইত্যাদি।
এই নীতির উপর ভিত্তি করেই কথিত ‘মানবতাবাদী’রা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ‘মানবতার সন্ত্রাসী’ কার্যক্রম।
তাদের এরূপ ‘মানবতা’র বলি হচ্ছে সারাবিশ্বের অসংখ্য মানব। আর, সিরিয়া হচ্ছে সেরকমই একটি ধ্বংসস্তুপের নাম, সেখানে এখন এরূপ ‘মানবতাবাদী সন্ত্রাসী’দের মিলনমেলা! সবাই একজোট হয়ে ‘নিরীহ শত্রু মুসলিম’দের উপর হামলা করছে!
সিরিয়ার এরকম ‘মানবতাবাদী সন্ত্রাসী’রা কেবল গত ২২শে জুলাইয়ে কমপক্ষে ৫৭ মানবকে হত্যা করেছে বলে জানায় ‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস’ নামক একটি সংস্থা।[১] নিহতদের মধ্যে ১৩ শিশু এবং ৭জন নারীও রয়েছে। এদের মধ্যে সিরিয়ার ইদলিবের মাআরাত আল-নুমান শহরের এক ব্যস্ততম জনপ্রিয় মার্কেটে বিমান হামলা চালিয়ে ২৫ এর অধিক মুসলিমকে হত্যা করেছে রাশিয়া, ঐ ঘটনায় আহত হয়েছে ৪০জনের বেশি। এভাবে, ২২শে জুলাইয়ে রাশিয়ার হাতে নিহত হওয়া মুসলিমের সংখ্যা ৩২জন বলে জানায় ‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস’ নামক সংস্থাটি। একইদিনে, সিরিয়ার আসাদ সরকারী বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে ১৫জন এবং অন্যান্য কয়েকটি দলের হামলায় নিহত হয়েছে আরো ১০জন সাধারণ মুসলিম। এটা কিন্তু কেবলই একদিনের খবর। এভাবে প্রতিদিনই চলছে হামলা, হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা।
‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস’ নামক সংস্থাটির তথ্যমতে, ২০১৯সালের ২৬শে এপ্রিল থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত রাশিয়া, সিরিয়ান সরকারী বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের হাতে নিহত হওয়া মুসলিমের সংখ্যা ৭৪৭জন, যাদের মাঝে রয়েছে ১৯২ শিশু ও ১৩১জন নারী! এসময়ের মধ্যে, মুসলিমদের উপর চালানো হয়েছে ৩২টি গণহত্যা এবং ৩১৬টি হামলা। [২]
বলতে বলতে সিরিয়ার কথা অনেক বলা হয়ে গেল!(?) তবে, আপনারা বিরক্ত না হলে মনে চাচ্ছে আরেকটি কথা বলি! তবে ভাবছি, কথাটি কি সহ্য করতে পারবেন? যাইহোক, বলেই ফেলি!
সিরিয়ার ইদলিব অঞ্চল এখন ইসলামের দুশমনদের আঘাতে বিধ্বস্ত, পূর্বের কথাগুলো থেকে তো বুঝতেই পারছেন সেখানে রাশিয়ান বিমানগুলো মুসলিমদের উপর বোমা ফেলছে! কিন্তু, দুঃখের বিষয় হলো- মুসলিমদের একটি বড় অংশ যাকে উম্মাহর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা মনে করে, সেই এরদোগানের দেশ তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া সিরিয়ান শরণার্থীদের এক বিশাল অংশকে সিরিয়ার ইদলিবে জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করছে কর্তৃপক্ষ। সংবাদসংস্থা ‘মিডল ইস্ট আই’ এর তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে তুরস্ক মোটামুটি ১ হাজার সিরিয়ান শরণার্থীকে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইদলিবে পাঠিয়ে দিয়েছে! [৩]
জীবন বাঁচানোর তাগিদে তুরস্কে আশ্রয় নেওয়া এসকল শরণার্থী মুসলিমকে কেবলই অবৈধভাবে (!?) তুরস্কে প্রবেশ করা কিংবা রেজিস্টার্ড হলেও কেবলই সাথে শরণার্থী কাগজপত্র না থাকার অপরাধে (!) পুনরায় জোরপূর্বক সিরিয়ার যুদ্ধাঞ্চলে পাঠিয়ে দিয়েছে এরদোগান সরকারের কর্তৃপক্ষ। বার্তা সংস্থা ‘মিডল ইস্ট আই’ জানিয়েছে, এ সময়ের মধ্যে দেশটির ইস্তাম্বুল থেকে আরো অন্তত ৫০০০ শরণার্থী সিরিয়ান মুসলিমকে গ্রেফতার করেছে তুরস্ক কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানানো ব্যক্তিদের মধ্যে ৮৭% মানুষই তুরস্কের এই প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশে এমন কোনো অজুহাতেই শরণার্থীদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের বিষয়টি মেনে নেওয়া যায়না। অবশ্য, এরদোগানের পক্ষ থেকে এর আগেই সিরিয়া ইস্যুতে যেরূপ নীতি প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আশা করা যায় না। গত বছর রাশিয়ার সাথে ‘সুচি চুক্তি’র ব্যাপারে এরদোগানের প্রশংসা বাক্যের কথা মনে আছে নিশ্চয়?
ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাওলা! এই উম্মাহর দুঃখ-দুর্দশা দূর করে দিন, হারানো সেই গৌরব ফিরিয়ে দিন, আমীন ইয়া রাব্বি।
তথ্যসূত্র:
লেখক: খালিদ মুন্তাসির, সম্পাদক, আল-ফিরদাউস নিউজ।