ইসলামের তারকাগণ | ৮ম পর্বঃ হযরত ইকরামা ইবনে আবু জাহল রাদিয়াল্লাহু আনহু (২)

0
2500

দেখতে দেখতে হিজরতের নয়টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মভূমি মক্কা। মুশরিকদের অত্যাচারে তিনি প্রিয় এ ভূমি থেকে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু, এবার সময় এসেছে বদলা নেওয়ার। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশ হাজার জানবাজ মুসলিমের বিরাট বাহিনী নিয়ে অতি সন্তর্পণে সেই মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে মক্কার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হলেন। কুরাইশ দলের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান অবস্থা বেগতিক দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। এরকম অপ্রস্তুত অবস্থায়ই তিনি মুসলিম টহল দলের হাতে ধরা পড়লেন। ধরা পড়ার পর তাঁকে হত্যা কিংবা জিম্মি না করে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আবু সুফিয়ানের হৃদয়কে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দিলেন এবং আবু সুফিয়ান নিজেই ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মিলে গেলেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সেনাদলকে অত্যন্ত সতর্কভাবে সাধারণ কুরাইশ, নারী ও শিশু, এছাড়া আর যারা যুদ্ধ হতে পেছনে থাকবে তাদের একজনকেও আক্রমণ না করতে আদেশ করলেন। এ ছিলো পৃথিবীর সমর ইতিহাসে একটি একক ও অনন্য ঘটনা।
মক্কার বিভিন্ন প্রবেশপথে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন কৌশলী সাহাবীর নেতৃত্বে সেনাদল পাঠালেন। আর এমনি এক সেনাদলের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। খালিদ কিছুদিন আগেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু, খালিদের এক সময়ের বন্ধু ইকরিমা তখনো ইসলামের ঘোর শত্রু! মক্কার অধিকাংশ লোক এবং যোদ্ধা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন নীরবে মেনে নিলেও ইকরিমা ছিলেন বিপরীত। তিনি মুসলিমদের যেভাবেই হোক প্রতিহত করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। বিশ্বস্ত কিছু সৈন্য সাথে নিয়ে কুরাইশদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ইকরিমা মুসলিম বাহিনীর বিরোধিতায় অটল থাকলেন। ক্ষুদ্র সে বাহিনী নিয়ে মুখোমুখি হলেন খালিদের নেতৃত্বাধীন এক মুসলিম বাহিনীর। একসময় যে দুজন ছিলেন অন্তরঙ্গ বন্ধু, একসাথে যুদ্ধ করেছেন মুসলিমদের বিরুদ্ধে, আজ সেই খালিদ-ইকরিমা মুখোমুখি। কিন্তু, সাইফুল্লাহ তথা আল্লাহর তলোয়ার উপাধীতে ভূষিত খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর সামনে টিকতে পারেনি ইকরামার বাহিনী। কিছু সময়ের মধ্যেই ইকরামার বাহিনীকে পরাজিত করলেন মুসলিমরা। মুশরিক দলের অনেকে নিহত হলো, বাকিরা কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেলো। আর পালিয়ে যাওয়া লোকদের মধ্যে একজন ছিলেন ইকরিমা।
এদিকে, রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পৃথিবীর সমর ইতিহাসে সেরা ক্ষমা ও দয়ার নজির প্রদর্শন করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, সকল নারী ও শিশু নিরাপদ, যারা নিজ গৃহে অথবা কাবাগৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ, যারা আবু সুফিয়ান এর গৃহে আশ্রয় নিয়েছে তারা নিরাপদ। এভাবে তাঁর ঘোষণার মাধ্যমে প্রায় সমস্ত মক্কাবাসী নিরাপত্তা লাভ করল। তবে সাধারণ ক্ষমার মধ্য থেকেও তিনি কয়েকজন চিহ্নিত লোকের নাম বললেন। এসকল লোকদেরকে তিনি ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর, এই তালিকার শীর্ষ ব্যক্তিটির নাম ছিল ইকরিমা ইবনে আবু জাহেল। ইকরিমার কানে যখন এ ঘোষণা পৌঁছাল তখন তিনি আর দেরি না করে দ্রুত মক্কার সীমানা অতিক্রম করে ইয়েমেনের দিকে পালানোর জন্য ঘোড়া ছুটালেন।

***
ইতিমধ্যে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীম এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দা আরো প্রায় দশজন মহিলার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্যাম্পে উপস্থিত হলেন। হিন্দা উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা সায়্যিদুশ শুহাদা হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কলিজা চিবিয়ে কুখ্যাত ছিলেন। কিন্তু, আজ তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন, অনুতপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে এসেছেন। সাথে ইকরিমার স্ত্রী উম্মু হাকীমও আছেন।

উম্মু হাকীম উঠে দাঁড়ালেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে ইসলামে প্রবেশের ঘোষণা দিয়ে বললেন, ”ইয়া রাসূলুল্লাহ্, আপনি তাঁকে পেলে হত্যা করবেন এই ভয়ে ইকরামা মক্কা থেকে পালিয়ে ইয়েমেনের দিকে চলে গেছে। আপনি তাঁকে নিরাপত্তা দিন, তাহলে আল্লাহ্ও আপনাকে নিরাপত্তা দেবেন।”
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অঙ্গীকার করলেন-”সে নিরাপদ”,
উম্মু হাকীম এক মুহূর্তও দেরী করলেন না, তখনই বেরিয়ে পড়লেন ইকরিমার খোঁজে, ইয়েমেনের পথে। আর নিজ নিরাপত্তার জন্য এক গ্রীক কৃতদাসকে সঙ্গে নিয়ে নিলেন।

পথিমধ্যে তাঁরা যখন নির্জন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ঐ দাসটি জোর করে উম্মু হাকীমের শ্লীলতাহানি করতে চাইলো। কিন্তু উম্মু হাকীম কৌশলে তাকে কোন আরব লোকালয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন। লোকালয়ে পৌঁছানোর পরই উম্মু হাকীম সেখানকার অধিবাসীদের সব জানিয়ে সাহায্য চাইলেন। লোকালয়বাসী দ্রুত তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এল এবং গ্রীক কৃতদাসটিকে বেঁধে ফেলে তাদের কাছে বন্দী করে রেখে দিল। উম্মু হাকীম এবার একাই বেরিয়ে পড়লেন ইয়েমেনের পথে, ইকরিমার খোঁজে। বহু দূরের পথ, রাত আর দিন দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে অবশেষে তিনি লোহিত সাগরের তীরে তিহামা নামের একটি এলাকায় ইকরিমাকে ধরতে পারলেন। ইকরিমা তখন সাগর পাড়ি দেবার জন্য একজন মুসলিম নাবিকের সাথে বাদানুবাদ করছিলেন। নাবিক ইকরামাকে বলছিলেন,
– “আগে আপনি পবিত্র হয়ে আসুন, তবেই আমি আপনাকে নিয়ে সাগরে নামব।”
– “কিন্তু আমি কীভাবে পবিত্র হব?” ইকরামা জানতে চাইলেন ।
– “আপনি এ কথার সাক্ষ্য দান করুন যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল।”
– “আমি তো এর জন্যই এখানে পালিয়ে এসেছি।”
ইতিমধ্যেই দুজনের মধ্যে এসে উপস্থিত হলেন উম্মু হাকীম। বললেন, ”আমার চাচাতো ভাই (আত্মীয়তার দিক দিয়ে এরা দুজন চাচাতো ভাই-বোন ছিলেন), আজ আমি আপনার কাছে এসেছি সেই অনন্য সাধারণ, সঠিক পথের দিশারী আর সব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মাদ ইবন্ আব্দুল্লাহর কাছ থেকে। আমি তাঁর কাছে আপনার জন্য নিরাপত্তা চেয়েছি, তিনি আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। এখন আপনি আর নিজেকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবেন না।”
ইকরিমা অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এতদূরে তাঁর স্ত্রী একাকী কীভাবে এসে পৌঁছালেন! আর মুহম্মাদ, যাঁর সাথে ইকরামার এত শত্রুতা, যিনি তাঁকে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা! নিজের কানকে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না ইকরামা। তিনি স্ত্রীকে বললেন, ”তুমি কি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছ?” উম্মু হাকীম উত্তরে বললেন, ”হ্যাঁ, আমি নিজে তাঁর সাথে কথা বলেছি এবং তিনি নিজেই আপনাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন।”
ইকরিমা ফিরে চললেন মক্কার পথে। পথে উম্মু হাকীম সেই রুমিও গোলামের কথা স্বামীকে জানালেন। ভয়াবহ ক্রোধে জ্বলে উঠলেন ইকরিমা, সরাসরি সে এলাকায় চলে গেলেন যেখানে ভৃত্যটি আটক অবস্থায় ছিল। ইকরিমা ঐ লম্পট দাসকে সেখানে হত্যা করলেন এবং আবার এগিয়ে চললেন মক্কার পথে। পথিমধ্যে যেখানে তারা বিশ্রামের জন্য থেমেছিলেন, সেখানে এক রাতে স্ত্রীকে একান্তে পেতে চাইলেন। উম্মু হাকীম ছিটকে সরে এলেন এবং তাঁর সাথে মিলিত হতে অস্বীকার করলেন। বললেন, ”আপনি আমার সাথে মিলিত হতে পারবেন না, কারণ আমি মুসলিমা আর আপনি হলেন মুশরিক।”
ইকরিমা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী মুসলিম হয়েছে একেবারেই সেদিন, আর তাঁরা দুজন মিলিত হলে আর তো কেউ দেখছে না, ঈমান তাঁকে এতটুকু পরিবর্তন করেছে! স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, ”এ তো কোন সহজ বিষয় নয় যা তোমার আর আমার মিলন এবং এতদিনের সম্পর্কের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে”। ইকরিমা মক্কায় প্রবেশ করলেন।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর মক্কায় প্রবেশের আগেই সাহাবীদের ডেকে ঘোষণা দিলেন, ”ইকরিমাহ্ ইবন্ আবী জাহল তোমাদের মধ্যে মুসলিম এবং মুহাজির হয়ে আসছে। তোমরা তাঁর পিতাকে গালি দিও না, কেননা মৃতকে গালি দিলে তা তাদের কাছে পৌঁছায় না।”
কিছুক্ষণের মধ্যে ইকরিমা সেখানে প্রবেশ করলেন যেখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বসে ছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উঠে দাঁড়ালেন এবং উষ্ণ আলিঙ্গনে ইকরিমাকে স্বাগত জানালেন।
ইকরিমা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে তাঁর হাত প্রসারিত করে বললেন, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নাই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসূল”। এরপর বললেন,“ইয়া রাসূলুল্লাহ্ , আপনি আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, তিনি যেন আমাকে ইসলামের বিরুদ্ধে আমার সকল শত্রুতা ক্ষমা করে দেন এবং আপনার উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায় আমি আপনার নামে যে সকল নিন্দা করেছি আর কুৎসা রটনা করেছি সেগুলো যেন তিনি ক্ষমা করে দেন।”
রাসূলুল্লাহ্ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে এ বলে প্রার্থনা করলেন যে, “হে প্রতিপালক, আমার বিরুদ্ধে যত শত্রুতা সে করেছে এবং তোমার আলোকে নিভিয়ে দেবার যত চেষ্টা সে করেছে, তার জন্য তাঁকে ক্ষমা করে দাও। আমার সামনে বা পেছনে আমার সম্মানহানীর জন্য যা কিছু সে বলেছে, তার জন্যও তাঁকে ক্ষমা করে দাও।”
ইকরিমার মুখ গভীর আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “আল্লাহর শপথ ইয়া রাসূলুল্লাহ্, আমি শপথ করছি, যা কিছু আমি আল্লাহর পথের শত্রুতার জন্য ব্যয় করেছি, তার দ্বিগুণ আমি ব্যয় করব আল্লাহর পথে, আর ইসলামের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধ আমি করেছি তার দ্বিগুণ যুদ্ধ আমি আল্লাহর পথে করব।”
সেদিন থেকে ইকরিমা একনিষ্ঠভাবে ইসলামে প্রবেশ করলেন। মুসলিম হিসেবে প্রতিটি যুদ্ধে তিনি জীবনবাজি রেখে অংশ নিতে লাগলেন এবং তাঁর দ্রুতগামী ঘোড়া কাফেরদের হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দিতে লাগল।

[এটা হযরত ইকরামা ইবনে আবু জাহল রাদিয়াল্লাহু আনহুর জীবনীর ২য় অংশ, পরবর্তী ও শেষ অংশ  পেতে চোখ রাখুন আল-ফিরদাউস নিউজে ইনশাআল্লাহ। আর, প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন]

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারত-পাকিস্তানের ক্ষমতার লড়াইয়ে কঠিন হয়ে উঠছে কাশ্মীর সীমান্তবাসীদের জীবন!
পরবর্তী নিবন্ধসৌদির কারাগারে বন্দী কয়েকজন প্রখ্যাত আলেমের নাম ও বন্দীত্বের সময়