উন্নয়নের ধোঁয়া-ধূলি মিশ্রিত ঢাকার বায়ু

0
761
উন্নয়নের ধোঁয়া-ধূলি মিশ্রিত ঢাকার বায়ু

বৈশ্বিকভাবে বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়াল কর্তৃক প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন-২০১৮’তে বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল শীর্ষে।

এয়ার ভিজ্যুয়াল বিশ্বের প্রায় ৩ হাজার শহরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণপূর্বক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার পাশাপাশি তাদের ওয়েবসাইটে প্রতি ঘণ্টায় বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরগুলোর দূষণের ক্রম হালনাগাদ করে থাকে।

এয়ার ভিজ্যুয়াল মূলত বাতাসে ভাসমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা পার্টিকুলেট ম্যাটারের (পিএম ২ দশমিক ৫) উপস্থিত মাত্রার ওপর নির্ভর করে এ পরিমাপ করে থাকে।

এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সির (ইপিএ) মতে পিএম ২ দশমিক ৫ হল বাতাসে বিদ্যমান অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা অ্যামবিয়েন্ট এয়ারব্রোন পার্টিকেলস যার আকার ২ দশমিক ৫ মাইক্রোন।

আমাদের মাথার চুল যেখানে ৭০ মাইক্রোন, সেখানে ধারণাগত দিক থেকে বোঝা যায় এ পিএম ২ দশমিক ৫ আসলে কতটা সূক্ষ্ম কণা।

এয়ার ভিজ্যুয়াল সর্বজনস্বীকৃত বায়ুমান সূচকের আলোকে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা পরিমাপ করে থাকে। এই সূচকে যদি কোনো এলাকার বায়ুতে পিএম ২ দশমিক ৫-এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ১২ মাইক্রো গ্রামের কম হয়, তাহলে সেটার লেভেল হল ভালো।

যদিও এই ভালো এর মাত্রা হল প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রো গ্রামের কম। এভাবে এই সূচকে কোন শহরের বাতাসে যদি পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫৫ দশমিক ৫-১৫০ দশমিক ৪ মাইক্রো গ্রাম হয় তাহলে সেটা অস্বাস্থ্যকর।

আর যদি সেটা ১৫০ দশমিক ৫-২৫০ দশমিক ৪ মাইক্রো গ্রাম হয়, তাহলে সেটা চরম অস্বাস্থ্যকর। সুতরাং এয়ার ভিজ্যুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশের বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ছিল ৯৭ দশমিক ১, যা অস্বাস্থ্যকর মাত্রার।

বাংলাদেশের বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর এই মাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার দূষণ আলোচনায় শীর্ষে থাকা ভারতের নয়াদিল্লি ও পাকিস্তানের করাচি শহরকেও পেছনে ফেলেছে।

২০১৮ সালের মতো ২০১৯-এর শেষ ভাগের সাম্প্রতিক সময়গুলোতেও এয়ার ভিজ্যুয়ালের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ঢাকা শহরের অবস্থান বিশ্বের সর্বোচ্চ দূষিত শহরগুলোর মধ্যে আছে।

যুগান্তরের বরাতে জানা যায়, ২০১৯-এর নভেম্বরেও ঢাকার বাতাসে পিএম ২ দশমিক ৫-এর মাত্রা ছিল গড়ে ১৫০ এর ওপরে, যা ইউএস একিউআই সূচকে চরম অস্বাস্থ্যকর বলে বিবেচিত।

দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই নগর এলাকায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু দূষণের কারণে হয়েছে। বিশ্বে ১৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয় দূষণে।

বাংলাদেশে তা ২৮ শতাংশ। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠেও ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারসহ রোগবালাই।

ঢাকার সড়ক ও ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ নিয়ে এ বছরের শুরুতে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট এবং এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলুশন রিসার্চে প্রকাশিত দুটি গবেষণা প্রতিবেদনে এসব ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে। গবেষণায় ঢাকার রাস্তার ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়াম থাকার কথা, ধুলায় তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে।

আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের ঝুঁকি আগেই ছিল, এবার ঢাকার রাস্তার ধুলার মধ্যেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল।

এসব ভারি ধাতু কণার আকার এতটাই সূক্ষ্ম যে, তা মানুষের চুলের চেয়ে ২৫ থেকে ১০০ গুণের বেশি ছোট। ফলে খুব সহজেই এসব সূক্ষ্ম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসছে; শ্বাসপ্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয়র মাধ্যমে মানুষের শরীরেও প্রবেশ করছে। গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা রাজধানীর ২২টি সড়কের ৮৮টি এলাকার সবখানেই কম-বেশি ভারি ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত সারা বছরে নগরব্যাপী চালিত অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রতিনিয়তই ঢাকার দূষণের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করছে।

মন্তব্য করুন

দয়া করে আপনার মন্তব্য করুন!
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

পূর্ববর্তী নিবন্ধভারতে নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করলেন আল্লামা শফী
পরবর্তী নিবন্ধসম্পাদকীয় (Video) | যে কারণে মার্কিন নৌ-ঘাঁটিতে হামলা করেছেন হেজাযের বৈমানিক!