দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে। একদিকে সরকারি খাতে বেশি ঋণ যাচ্ছে, অন্যদিকে আগে বিতরণ হওয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। ওইসব খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশনও রাখতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।
তথ্য অনযায়ী, গত বছরের (২০১৯) সেপ্টেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বরে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৬১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকায়। মূলধন ঘাটতিতে থাকা মোট ১২টি ব্যাংকের মধ্যে ৫টি সরকারি, ৪টি বেসরকারি, একটি বিদেশি এবং দুইটি বিশেষায়ীত ব্যাংক। এদের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঘাটতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ডিসেম্বর শেষে মোট ১০ হাজার ৭৭৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা মূলধন ঘাটতিতে সরকারি খাতের ৫টি ব্যাংক। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে ২ হাজার ৫৭৩ কোটি, বিশেষায়ীত ব্যাংকগুলোতে ১০ হাজার ১৯৯ কোটি এবং বিদেশি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি প্রায় ৬২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে বড়ো সমস্যা খেলাপি ঋণ। আর খেলাপি ঋণের কারণেই মূলধন ঘাটতিও বাড়ছে। বেসরকারি ব্যাংকে ঘাটতি বেশি না হলেও সরকারি খাতে ঘাটতি অনেক বেশি। সরকারি ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের ঘাটতি পূরণ করা হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে, যা মোটেও উচিত নয়। এটি বন্ধ করা উচিত।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১০ লাখ ১১ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে পড়েছে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। তিন মাস আগে (সেপ্টেম্বর) মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকা কমেছে।
খেলাপি ঋণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মূলধন ঘাটতি বাড়ে। কিন্তু এবছর খেলাপি কমলেও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। এবিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবীদ জাহিদ হোসেন অর্থসূচককে বলেন, এবারের খেলাপি কমার কারণ হল রিশিডিউল। সেকারণেই মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। তাছাড়া মূলধনের পর্যাপ্ততা বাড়াতে হলে পরিচালন মুনাফা বাড়াতে হয় অথবা নতুন আমানত বাড়াতে হয় অথবা লভ্যাংশ কমাতে হয়। এর কোনোটাই ঘটেনি। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে মূলধন ঘাটতি বৃদ্ধি খুবই স্বাভাবিক।
মূলধন ঘাটতিতে থাকা সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সোনালী ব্যাংকের। বিদায়ী বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির মোট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ৫ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ৪৯০ কোটি, অগ্রণী ব্যাংকের ১ হাজার ২৯৪ কোটি, রূপালী ব্যাংকের ২০১ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯৬১ কোটি টাকা। বেসরকারি চারটি ব্যাংক মিলে আড়ায় হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৬২ কোটি টাকা। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৯ হাজার ৪১১ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৭৮৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে।
ব্যাংকগুলোর শেয়ারহোল্ডার বা মালিকদের জোগান দেওয়া অর্থই মূলধন হিসেবে বিবেচিত। সারা বিশ্বে ব্যাসেল কমিটি প্রণীত আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে একটি ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনেক দিন ধরেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফিরছে না। উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগে আসছেন না। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকেই শিল্পকারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আর ব্যাংকের বেশির ভাগ ঋণই যাচ্ছে সরকারের ঘরে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাত ঋণ পাচ্ছে না। আবার আগে বিতরণ হওয়া ঋণের টাকাও ফেরত পাচ্ছে না ব্যাংক। ফলে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে।