সরকারি তথ্যমতে, পঞ্চগড় জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ছোট-বড় ৩৩টি নদী। অবশ্য নদী গবেষকরা বলছেন, এ জেলার ওপর দিয়ে ৪৬টি নদী প্রবহমান। তাদের মতে, এত নদী অন্য কোনো জেলায় নেই। তাই পঞ্চগড়কে নদীর জেলাও বলছেন তারা।
বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ নদীই অর্ধমৃত। দখল আর দূষণের কবলে পড়ে স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলেছে এসব নদী। নদীর বুকজুড়ে এখন ফসলের মাঠ।
রিপোর্ট বিডি প্রতিদিনের
অপরিকল্পিতভাবে নদীতে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। নদীর বুকে বিভিন্ন আবাদ করছেন চাষিরা। ব্যবহার করছেন সার ও কীটনাশক। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে নদীর মাছ ও নানা জাতের প্রাণী। ফলে জেলার পরিবেশ প্রকৃতি বিপন্ন। পঞ্চগড়ের করতোয়া, ডাহুক, পাম, ছেতনাই, তালমা, গোবরা- এ ৬টি নদীর ১৩৩ জন দখলদার প্রায় ৪০ একর জমি দখল করে রেখেছে বলে নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এ তালিকা মানতে নারাজ স্থানীয় পরিবেশবাদীরা। তাদের দাবি, প্রায় সব নদীতেই দখলদার রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শক্ত শিকড় গেড়েছেন এসব দখলদার। এদিকে নদী পাড়ে গড়ে ওঠা শহর, হাট-বাজারের ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলা হচ্ছে
প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ নেই। অভিযোগ উঠেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী দখলমুক্ত করার নামে শুধু দরিদ্রদের উচ্ছেদ করছে। প্রভাবশালীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও প্রশাসনের যোগসাজশে নদী দখল করে তুলেছেন স্থায়ী স্থাপনা, গড়েছেন বাগান, নির্মাণ করেছেন বিনোদন পার্ক। জেলা শহরের তালমা এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় তালমা নদীর প্রায় সাড়ে ৮ একর জমি দখল করে হিমালয় বিনোদন পার্ক গড়ে তুলেছেন শাহীন নামের এক ব্যবসায়ী। বাংলো, সুইমিং পুল, শিশুদের বিভিন্ন রাইডিং, জীবজন্তুর প্রতিকৃতিসহ নদীর ওপর স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তার পাশেই প্রায় সাড়ে ৭ একর জমি দখল করে স্থাপনা তুলেছে সৌদি বাংলা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ইকো ফ্রেন্ড লিমিটেড। নদীর কিছু অংশ দখল করে সীমানাপ্রাচীর তুলেছেন জেলা কৃষক লীগ নেতা আপেল মাহমুদও। বোদা উপজেলায় করতোয়া ও পাম নদীর তিন একরেরও বেশি জমি দখল করে ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন গাছের বাগান গড়ে তুলেছেন নাবিলা অরচার্ড অ্যান্ড লিমিটেডের দাউদ খালিদ সারোয়ার। অথচ এসব দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নিতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট লিমিটেড, জেমকন টি এস্টেট লিমিটেড, পঞ্চগড় টি কোম্পানি লিমিটেড, কাঞ্চনজঙ্ঘা টি কোম্পানি লিমিটেডসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীদের নামও রয়েছে। এদিকে শহর হাট-বাজারের আশপাশে প্রবহমান প্রায় সব নদীতেই ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। জেলা শহরের করতোয়া নদীতে রাতের অন্ধকারে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে হোটেল মালিকরা। তেঁতুলিয়া উপজেলা শহরে গোবরা, বোদায় পাম ও দেবীগঞ্জ উপজেলা শহরের ময়লা-আবর্জনা করতোয়া নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে এসব নদী সংকুচিত হয়ে প্রায় মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে মরে গেছে ডাহুক নদী। ভারত থেকে বয়ে আসা নদীটি এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের করা নদী দখলদারদের তালিকা ধরে সারা দেশের মতো পঞ্চগড়েও ২৩ ডিসেম্বর উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও স্থানীয় প্রশাসন। ওই দিনই জেলা শহরের করতোয়া নদীর তুলারডাঙ্গা বাঁধ ঘেঁষে গড়ে তোলা ৯৬টি দরিদ্র পরিবারের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করেই অভিযানের ইতি টানেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ নদী রক্ষা কমিশনের প্রকাশিত নদী দখলদারদের তালিকায় থাকা পঞ্চগড়ের প্রভাবশালীদের স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন পঞ্চগড়ের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, নদী রক্ষা কমিশন পঞ্চগড়ের নদী দখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা সম্পূর্ণ নয় বলে আমরা মনে করি। প্রত্যেকটি নদীতেই দখলদার রয়েছে। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসন যে অভিযান পরিচালনা করছে সেটিকে নামমাত্র বলাই ভালো। নদীতে চাষাবাদের ফলে নদীর মাছসহ অন্যান্য জলজপ্রাণী বিলুপ্তির দিকে। আমাদের দাবি নদী বাঁচানোর স্বার্থে প্রত্যেক নদী থেকেই দখলদারদের উচ্ছেদ করে নদীর স্বাভাবিক গতিধারা ও প্রকৃতি ফিরিয়ে দিতে হবে। অভিযোগ অস্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, শীতের কারণে উচ্ছেদ অভিযান স্থগিত রেখেছিলাম। ক্রমান্বয়ে প্রত্যেক নদীর দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে। সে যতই প্রভাবশালী হোক।