ভারতে মুসলমানদের প্রতি মালাউনদের বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। কিছুদিন পর পর বিভিন্ন ভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায় ভারতীয় হিন্দুরা। কিছুদিন আগেও এনআরসি ও সিএএ নিয়ে ভারতে দেখা গিয়েছিলো চরম মুসলিম বিদ্বেষ। দিল্লিতে চালানো হয়েছিল মুসলিমদের উপর নির্মম গণহত্যা। এবার ভারতে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের দুঃসময়ে মুসলিম বিদ্বেষ নতুন মাত্রা পেয়েছে।
বেশ কয়েকদিন আগে দিল্লির তাবলিগ জামাতের মারকাজে একটি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কয়েক হাজার মুসল্লি সেই সমাবেশে যোগ দেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের অনেক মুসল্লিও ছিলেন সেখানে। বিভিন্ন দেশের লোকের উপস্থিতির কারণে এটিকে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ‘হটস্পট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে মালাউনরা। বিষয়টি মিডিয়ায় এমনভাবে উপস্থাপন করার ফলে তীব্র মুসলিম বিদ্বেষী আচরণ দেখা যাচ্ছে ভারতে।
দেশটির বড় বড় হলুদ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান দিল্লির মুসল্লিদের ‘করোনা জিহাদি’, ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি শব্দে সম্বোধন করেছে। যা স্পষ্টতই সাধারণ মানবাধিকারের লঙ্ঘন। একইসাথে মিথ্যা ও ইসলাম বিদ্বেষমূলক সংবাদ ছড়াচ্ছে বিভিন্ন ভারতীয় মিডিয়া।
মারকাজের সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৯ থেকে ১৩ মার্চ। একই সময়ে বা এর পরে ভারতে অন্য ধর্মীয় মানুষদের একাধিক বড় আয়োজনও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সে সব আয়োজন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে তেমন কোনো প্রশ্ন ছোড়া হচ্ছে না। সব অভিযোগের তীর তাক করা হয়েছে শুধু তাবলিগের সমাবেশের দিকে। অথচ, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে করোনা তাড়ানোর নামে থালা-বাটি বাজানোর হাস্যকর কাণ্ডে অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। এই আয়োজনেও প্রচুর লোক সামাজিক দূরত্বের যে পদ্ধতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তা লঙ্ঘন করেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা ছিলো এই আয়োজন থেকেও।
কিন্তু, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ার সেদিকে নজর নেই! তারা করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণ হিসেবে তাবলিগ জামাআতকে দায়ী করছে। আর, এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে চরমমাত্রায় মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেমন এপিপি নিউজ হিন্দি চ্যানেলটি তাবলিগের লোকজনকে ‘কোভিড-১৯ যোদ্ধা’ বলে অভিহিত করেছে। জি নিউজ বলেছে ‘সুইসাইড বোম্বার’। তারা এমন কি তাবলিগ জামাতের সেই সমাবেশে উপস্থিত থাকা মুসলিমদেরকে ইসলামী জিহাদী জামাআত আল কায়েদার সাথে যোগাযোগ আছে বলেও মন্তব্য করেছে। জি নিউজ তাবলিগ জামাতের শীর্ষ এক আলেমকে ‘মওত কি মাওলানা’ বলে অভিহিত করেছে।
ইন্ডিয়া টিভি নামে আরেকটি চ্যানেল করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়া মুসলিমদেরকে ‘করোনা বোম্ব’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছে, “ভগবান জানেন সারা দেশে কতগুলো করোনা বোম্ব ছড়িয়ে পড়েছে।” অথচ ভারতের প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয় বহু পূর্বে।
রিপাবলিক ভারত নামের একটি টিভি চ্যানেল আবার তাবলিগের এক শীর্ষ আলেমকে ভারতে করোনা ছড়িয়ে দেওয়ার ‘মাস্টার মাইন্ড’ বলে অভিহিত করেছে। শুধু তাই না, এই চ্যানেলটিতে ‘ভারতে করোনা ছড়িয়ে দিলো তাবলিগ জামাত’ শিরোনাম প্রচার করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। এই চ্যানেলের এক সাংবাদিক,তাবলিগ জামাতকে ‘জীবনের জন্য হুমকি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ইন্ডিয়া নিউজ নামে একটি চ্যানেল তাবলিগ জামাতের আয়োজনটিকে ‘করোনা জিহাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
ইন্ডিয়া টুডের মতো প্রতিষ্ঠিত একটি সংবাদমাধ্যম, তাবলিগ জামাতের করোনায় আক্রান্ত লোকদেরকে ‘তাবলিগি জামাত পেশেন্ট’ বলে অভিহিত করেছে। যেনো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবার দরকার নেই, মুসলিম হওয়াই ভারতে করোনা রোগী হিসেবে আখ্যায়িত হবার জন্য যথেষ্ট । এই মাধ্যমটি দাবি করেছে যে, নিজামুদ্দিন মারকাজ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিগণ হাসপাতালে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছেন। নগ্ন হয়ে চলাফেরা করছেন। অথচ এই দাবির পক্ষে শক্ত কোনো প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেনি। আর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
‘সংবাদ প্রতিদিন’ মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে প্রমাণিত বিজেপি সরকারের মালাউন নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয়র একটি মন্তব্যকে শিরোনাম করেছে এইভাবে: “নিজামুদ্দিনের ধর্মীয় সভায় যোগদানকারীরা মানববোমা’, বিস্ফোরক কৈলাস”।
শুধু এই সংবাদমাধ্যমগুলোই নয়, ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রতিটি সংবাদ মাধ্যম দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের সমাবেশের দোহাই দিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের করোনা ভাইরাস ছড়ানোর দায়ে অভিযুক্ত করে বক্তব্য দিচ্ছে। টকশো আয়োজন করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। যার ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মালাউনদের হামলার শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ মুসলিমদেরকে।
বার্তা সংস্থা ক্র্যাকটিভিস্ট (kractivist) সূত্রে জানা গেছে,ভারতের ঝাড়খণ্ডে গুজব রটানো হয়েছে যে, মুসলিমরা থুথু দিয়ে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই গুজবে প্রভাবিত হয়ে একজন মুসলিমকে হত্যা করা হয়েছে। আরও দু’জনকে গুরুতরভাবে আহত করা হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিচালক এমএল মীনা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানিয়েছে, এ ঘটনায় আদিবাসী একজন মুসলিম ছেলে মারা গেছেন এবং আরও দু’জন আহত হয়েছেন। ঘটনাটি জেলার ভাদৌলি গ্রামের কাছে ঘটেছিল বলে ইউনাইটেড নিউজ অফ ইন্ডিয়া জানিয়েছে ।
পুলিশ বলেছে যে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের একদল লোক এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে গিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে থুতু ছিটিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এই গুজবের ভিত্তিতে ভাদৌলি গ্রামের কাছে এক মুসলিম যুবককে সন্ত্রাসী হিন্দুরা মারধর করে। হাসপাতালে মারধরের শিকার মুসলিম যুবক মারা যান।
একইভাবে, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার মিথ্যা অপবাদ দিয়ে দিল্লিতে মাহবুব আলী নামের আরো এক মুসলিম যুবককে হত্যা করেছে মালাউনরা।
নিউজক্লিকের খবরে বলা হয়েছে, তাবলিগ জামায়াতের একটি গ্রুপের সাথে ৪০ দিন সময় কাটায় মাহবুব আলী ওরফে দিলশাদ। মধ্যপ্রদেশের রায়সেন জেলা থেকে ৫ এপ্রিল গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। তারপর, স্থানীয় হিন্দুরা আলীকে ঘিরে ফেলে প্রচুর মারধর করে। পরে, হাসপাতালে মাহবুব আলীর মৃত্যু হয়।
একইভাবে, ৭ই এপ্রিল নয়া দিল্লীর শাস্ত্রি নগরের একটা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, সে এলাকার বাসিন্দারা একে ওপরকে সাবধান করে দিচ্ছে কোনো মুসলমানকে যেনো তাদের এলাকায় ঢুকতে না দেওয়া হয়।
১ মিনিট ৫২ সেকেন্ড দীর্ঘ ভিডিও ক্লিপটিতে এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, “কোনও মুসলিমকে জাতীয় পরিচয়পত্র না দেখিয়ে এলাকায় প্রবেশ করতে বা এলাকা ত্যাগ করতে দেওয়া হবে না। এই লোকগুলো একটা গণ্ডগোল তৈরি করেছে। রোগ ছড়াচ্ছে।”
অন্য একটা ভিডিওতে দেখা গেছে, উত্তরাখণ্ডের মুসলিম ফল বিক্রেতাদের ফল বিক্রি করতে নিষেধ করা হচ্ছে। অথচ অমুসলিম বিক্রেতাদের বিক্রি চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয়দের দ্বারা হয়রানির অভিযোগে ৫ এপ্রিল হিমাচল প্রদেশের উনা জেলায় এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা গিয়েছে। তাবলিগ জামাতের সমাবেশে অংশগ্রহণ করা দুজন ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। যদিও করোনা পরীক্ষার পর তার দেহে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতির প্রমাণ মেলেনি। ।
ভারতজুড়ে এভাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে গুজব ছড়িয়ে মুসলিমদের দায়ী করা হচ্ছে করোনা ভাইরাস ছড়ানোর জন্য। সেই সাথে হিন্দুদের একের পর এক আক্রমণের শিকার হচ্ছেন অসহায় মুসলিমরা।