নব্বইয়ের দশকে আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিতে (এএমইউ) পড়ার সময় প্রথম যার সাথে আমার শারীরিক হাতাহাতি হয়, সে ছিল একজন কাশ্মীরি মুসলিম। হোস্টেলে টিভি সেটে যখন ক্রিকেট দেখছিলাম আমরা, তখন পাকিস্তানকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল সে, যদিও আমাদের দল ভালো ক্রিকেট খেলছিল।
পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী ছিলাম আমি। ভারতের বিজয় তুলে ধরে বানানো ফিল্মগুলো আমি পছন্দ করতাম। ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা’ গানটা শুনলেই আমার গলার মধ্যে একটা দলা পাকিয়ে উঠতো। ক্রিকেট ম্যাচে ভারতের হেরে যাওয়ার বিষয়টি টক অব দ্য টাউন হয়ে উঠলে হৃদয় ভেঙ্গে যেতো আমার। সব মিলিয়ে ভারতের জন্য আমার হৃদয়ে ক্ষরণ হতো এবং সবসময় আমি এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই যদিও আমার কথিত ‘অদেশপ্রেমিক’ মুসলিম বন্ধু আর খানিকটা ‘দেশপ্রেমিক’ হিন্দু বন্ধুরা পশ্চিমা দেশগুলোর সবুজ প্রান্তরের জন্য দেশ ছাড়ার পথ বেছে নেয়।
অন্যদিকে, এএমইউ-এর মতো জায়গায় আমার উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমি আলাদা হয়ে ছিলাম। আমার মতো মুসলিমদের ব্যঙ্গ করে ‘উদারীকৃত’ বলে ডাকা হতো। একইসাথে মুসলিম ও উদার হতে পেরে আমি ছিলাম গর্বিত। পরিচয় ছিল আমার কাছে একটা বেছে নেয়ার বিষয়।
এরপর সময় গেছে। ভারত বদলে গেছে। মালাউনদের হাতে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, গুজরাটসহ অসংখ্য মুসলিম গণহত্যা হয়েছে, উত্তেজনা বেড়েছে। এই সবকিছুই আমাদের পরিচয়ের উপর একটা ছায়া ফেলেছে। জীবনে প্রথমবারের মতো নিজেকে আরও বেশি মুসলিম মনে হচ্ছে আমার। নিজের পরিচয় বেছে নেয়ার সুযোগ আছে বলে যেটা মনে হতো একসময়, সেটা ধসে পড়েছে। গতানুগতিক মুসলিম নামধারী হওয়ায় মেট্রোপলিটন শহরে বাড়ি ভাড়া পাওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে আমার জন্য। আমার নাম জানার পর মানুষের ভাবভঙ্গি পালটে যায় এবং চেহারায় একটা সন্দেহ দেখা দেয়। আমি অফিসে ঢুকলে সবাই কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়। সময়ের সাথে সাথে আমাদের বেছে নেয়ার সুযোগগুলো সীমিত হয়ে গেছে। আমার পরিচয় নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। আমি একজন মুসলিম। এর বেশিও নয়, কমও নয়।
মোদি সরকার এসে শক্ত অবস্থান নেয়ার পর থেকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অত্যাচার নির্যাতন শুরু হয়ে গেলো। এটা আমাকে অস্থির করেছে। আমার প্রতিষ্ঠিত মুসলিম পরিচয়ের কারণে যে কোন সময় আমার জীবন শেষ হয়ে যেতে পারে। প্রকাশ্যে বিতর্ক করা আমি কমিয়ে দিলাম। প্রকাশ্যে ফোন কল রিসিভ করে আস সালামু আলাইকুম বলা বন্ধ করে দিলাম। সন্তানদের বললাম যাতে ট্রেন বা বাসে সফরের সময়ে আমাকে আব্বা বলে না ডাকে। এমনকি আমার নামটাও একটি ঘুরিয়ে নিলাম আমি। আমার খাবারের তালিকা থেকে মাংস চলে গেলো। যখন সফরে থাকি, তখন তো এটা আরও বেশি কঠোরভাবে অনুসরণ করি। কখনও আমি কল্পনাও করিনি যে, নিজের পরিচয় গ্রহণ করার সুবিধাটুকু আমাকে এভাবে পঙ্গু করে দিতে পারে। এই নতুন ভারতে একই সাথে মুসলিম আর উদারপন্থী হওয়ার পরিণতি সত্যিই ভয়াবহ।
আমি আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে শুরু করলাম। আমার পরিচয় নিয়ে আরও বেশি ভাবতে শুরু করলাম আমি, যতটা আর বাকি জীবনে কখনও করিনি। আমি এখনও দিনে পাঁচবার নামাজ পড়ি না এবং এখনও রমজানে রোজা রাখি না। কিন্তু আমি এখনও মুসলিম।
সোশাল মিডিয়ায় আমার নামটা দেখেই মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সহ-নাগরিকদের বিরুদ্ধে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে আমাকে দূরে ঠেলে দেয়া হলো এবং আমার নামে ট্রোল করা হলো। অদ্ভুত বিষয় হলো, যখন আমি জাত প্রথার বিরুদ্ধে লিখলাম, তখন আমার সমালোচনা করা হলো সবচেয়ে বেশি। ওয়েবসাইটের প্রতিটি পাতায় আমাকে কাফির, জিহাদি, দেশবিরোধী, মোল্লা, কাটুয়া বলে গালাগালি দেয়া হলো। ’তালেবান’ এবং আইসিসের সাথে আমার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হলো। আমার উদার চিন্তা নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হলো: “একজন মুসলিম কিভাবে গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে পারে?” আমি যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করলেই প্রতিপক্ষ আমাকে পাকিস্তানে চলে যেতে বললো, একজন এমনকি সৌদি আরবে চলে যেতেও বলেছে। সবসময় আমার মাথার উপর ঘৃণার মেঘ ঝুলে আছে। আমি এর উপস্থিতি সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে শুরু করলাম।
এই পুরো প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হলো আমাকে এটা উপলব্ধি করানো যে, আমার একমাত্র পরিচয় হলো মুসলিম। অন্য কোন পরিচয় আমার জন্য নয়। ধীরে ধীরে আমি নিজেও আমার দেশপ্রেমিক পরিচয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলাম। আমি মনে করি যেকোনো দমনমূলক ব্যবস্থার সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দুর্ভাগ্যজনক অংশ হলো যখন চরম বৈষম্যের মধ্যেও আশাবাদী পরিচয় দিয়ে অনেকে ঝিম ধরে বসে থাকে। একজন একজন করে আশাবাদী মানুষ যখন তাদের আশা হারাতে শুরু করেন, তখন বৈষম্যের শিকড় একটু একটু করে গভীর হয়। সিটিজেনশিপ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আমাকে আকর্ষণ করে, কিন্তু একজন মুসলিম হিসেবে শুধু, যে কিনা দেয়ালের লেখাটা পড়তে পারছিল। গণতন্ত্রের একজন উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে আমার যে উদ্বেগ, সেটা সন্ধ্যার আকাশের মতো ভেতরে ভেতরে মিলিয়ে যাচ্ছিল।
মানুষ আশা হারায় যখন সে আর ভালোবাসা পায় না। অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে গেলে এবং বৈষম্যের শিকার হলে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
২০১৯ সালের জুলাই মাসে ভারত যখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হেরে গেলো, তখন আমার এ জন্য খারাপ লাগেনি যে ভারত হেরে গেছে। অন্য কারণে আমি বরং একটু স্বস্তি পেয়েছিলাম। বিশ্বকাপের বিজয়কে মোদি তার ব্যক্তিগত প্রচারণার জন্য ব্যবহার করতে পারবেন না, এটা ভেবে ভালো লেগেছিল।
চীনা আগ্রাসনের খবর যখন আসলো, তখন বিষয়টাকে আমি দেখেছি একজন বহিরাগতের দৃষ্টিতে। আমি ও সেনারা উভয়েই যে ভারতীয়, সেই ভাবনা থেকে নয়। অন্যান্য ভারতীয়দের মতো অনুপ্রবেশের পর প্রধানমন্ত্রীর বিড়বিড় করা, মিথ্যা বলা দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত লেগেছে আমারও। একজন নেতা চরম অপমানিত হয়েছে, যার সরকার আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে চরম অপমান করে যাচ্ছে।
এই লেখাটা পরিচয় গোপন করে লিখলাম কারণ আমার একটা পরিবার আছে। চাকরি আছে। অনেক প্রতিবেশীদের মাঝখানে আমাকে বাস করতে হয়। এটা একটা নতুন ভারত এবং আমি একজন কাপুরুষ মুসলিম। পরিচয় গোপন রাখা ছাড়া আমার উপায় নেই।
সূত্র: দ্য ওয়্যার