ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মর্গ শুধু নামেই আধুনিক মর্গ। এখানে এখনো প্রাচীন আমলের ছুরি-কাঁচি দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। আলামত খুঁজতে লাশের বিভিন্ন অংশ কাটাকুটি করা হয়। অথচ উন্নত দেশ এমনকি পাশের দেশ ভারত ও নেপালে কাটাছেঁড়া ছাড়াই ময়নাতদন্ত পদ্ধতি চালু হয়েছে। এসব দেশে ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে এমআরআই, সিটি স্ক্যান ও এক্সরে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মর্গ ঢামেক ফরেনসিক মর্গে এসব যন্ত্রপাতির কোনোটিই নেই। এমনকি লাশ সংরক্ষণের যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। অব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হচ্ছে।
ঢামেক মর্গ সূত্রে জানা গেছে, এখানে চারটি এসির সবকটিই দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। আর লাশ সংরক্ষণের পাঁচটি ফ্রিজের মধ্যে দুইটি দীর্ঘদিন ধরে বিকল। আরেকটি ফ্রিজে দীর্ঘদিন ধরে তিন বিদেশি নাগরিকের লাশ রয়েছে। এছাড়া আইনি জটিলতায় এক ব্যবসায়ীর লাশ আটকে আছে। ফলে দুটি ফ্রিজ নিয়ে লাশ সংরক্ষণে সেখানকার কর্মীদের হিমশিম খেতে হয়। লাশ সংরক্ষণে অব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানান, ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালের মর্গে আগে প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০টি লাশের ময়নাতদন্ত হলেও এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ মর্গ হওয়ার পর এখানে আসা লাশের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। এরপরও এ মর্গে প্রতিদিন ৫-৬টি করে লাশ আসে। এর মধ্যে আত্মহত্যা, সড়ক দুর্ঘটনা, খুনসহ বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এছাড়া বেশির ভাগ অজ্ঞাতপরিচয় লাশ মরচুয়ারিতে রাখা হয়। প্রতিদিন অন্তত দুটি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ ঢামেক মর্গে আসে। শনাক্তের জন্য লাশগুলো সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু এসব লাশ সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বাধ্য হয়ে লাশগুলো মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। এছাড়া এসি বিকল থাকায় লাশেও পচন ধরেরোববার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মর্গের ফ্রিজে ছয়টি অজ্ঞাতপরিচয় লাশ রাখা হয়েছে।
মর্গের সহকারী সিকান্দর আলী যুগান্তরকে বলেন এসব অজ্ঞাতপরিচয় লাশ শনাক্ত না হলে কিছু দিন রাখার পর নিয়ম মেনে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়। তিনি বলেন, দুটি ফ্রিজে লাশ অদলবদল করে রাখি। একটি লাশ কয়েক ঘণ্টা ফ্রিজে রাখার পর তা বের করা হয়। এরপর বাইরে রাখা লাশ ফ্রিজে রাখা হয়। এভাবেই মর্গের কার্যক্রম চলছে। তিনি আরও জানান, ছুরি-কাঁচি দিয়েই এখানে ময়নাতদন্ত কার্যক্রম চালানো হয়।
মর্গের কর্মীরা জানান, ফ্রিজ সংকটে মেঝে অথবা স্টেচারের উপরে লাশ রাখা হয়। যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করায় অনেক সময় লাশে পচন ধরে যায়। সংরক্ষণ না করায় পচা-গলা গন্ধের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেন। ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই হাইকোর্ট ঢামেক হাসপাতাল মর্গের ফ্রিজ মেরামতের আদেশ দেন। প্রায় তিন বছরেও সেই আদেশ মানা হয়নি। ফরেনসিক বিভাগ সূত্র জানায়, বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। ফ্রিজগুলো সারাতে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বছরে অন্তত শতাধিক লাশ আসে। এগুলো আলামত সংরক্ষণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। গুলিবিদ্ধ কোনো লাশ মর্গে এলে গুলির চিহ্ন ধরে অনুমানভিত্তিক কেটেকুটে আলামত সংগ্রহ করতে হয়। অনেক সময় লাশ টুকরো টুকরো করে আলামত হাতড়ে বেড়াতে হয়। অথচ উন্নত দেশের মর্গে অত্যাধুনিক পোর্টেবল এক্সরে মেশিন রয়েছে। ডিজিটাল পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের মাধ্যমে মাত্র দুই মিনিটে লাশে থাকা বুলেটের অগ্রভাগ (প্রোজেক্টাইল) শনাক্ত করা যায়। ছড়রা গুলির প্যালেট, বোমা কিংবা এ জাতীয় বস্তুর স্পিন্টারসহ অন্যান্য আলামত বের করা যায়।
একজন চিকিৎসক জানান, পোর্টেবল এক্সরে মেশিনের দাম আকাশচুম্বী নয়। ৫-৭ লাখ টাকা হলে মেশিনটি পাওয়া যায়। অথচ আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে সনাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে পোস্টমর্টেমের কাজ করা হয়।
ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ফ্রিজ ও এসি মেরামতের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনেক আগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগে কয়েকবার ফ্রিজ সারানো হলেও কিছুদিন পরই আবার বিকল হয়ে যায়। তিনি বলেন, সঠিকভাবে লাশ সংরক্ষণ না করা গেলে মৃত্যুর কারণ নির্ণয়ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ফরেনসিক বিভাগ একটা অবহেলিত বিভাগ। ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটির কথা বেশ কয়েকবার মৌখিকভাবে উপস্থাপন করেছি। কিন্তু সেটা এখনো পাইনি।