হিজাব নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই ভারতের কর্নাটকের স্কুলগুলো (১০ম শ্রেণী পর্যন্ত) খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু, এখনো এ কর্নাটক রাজ্যের মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরিধানে বাধা দেয়া হচ্ছে। হিজাব না খুললে ছাত্রীদেরকে স্কুলের শিক্ষকরা পুলিশের ভয় দেখিয়েছে। স্কুলের আশেপাশে জারি করা হয়েছে ১৪৪ধারা। ৫ জনের অধিক একত্রিত হওয়ার উপর জারি করা হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। যেন মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব খুলতে হিন্দুত্ববাদীরা বাধ্য করলেও মুসলিমরা প্রতিবাদ করতে না পারে।
কর্নাটকের কিছু স্কুলে প্রবেশ করার সময় ছাত্রীদের হিজাব ত্যাগ করার কথা বলা হচ্ছে। মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব ত্যাগ করতে না চাইলে তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
গত সোমবার (১৪/০২/২২) স্কুলগুলি পুনরায় চালু হওয়াযর পর, কেপিসি স্কুলের ১৩ জন মুসলিম ছাত্রীকে হিজাবের কারণে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয়নি। তাদেরকে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। মুসলিম ছাত্রীরা সেকেন্ডারি স্কুল লিভিং সার্টিফিকেটের প্রি-বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে এসেছিল।
কর্ণাটক হাইকোর্ট রাজ্য জুড়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করার একটি অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার পরে কেপিএস স্কুলে হিন্দুত্ববাদীরা এই পদক্ষেপটি নেয়।
কেপিএস স্কুলের ছাত্রী মুবাশ্বিরা আলী জানান, “এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিন থেকে আমি হিজাব পরে আসছি এবং ২ বছর হয়ে গেছে। কেউ আমাকে আমার হিজাব খুলতে বলেনি। কিন্তু আজ যখন আমি এবং আমার সহপাঠীরা স্কুলে যাই, তখন আমাদের অধ্যক্ষ আমাদের মাঝপথে থামিয়ে দেয়। স্কুলের গেটের সামনে অনেক হিন্দুত্ববাদী মিডিয়া চ্যানেল ছিল। প্রিন্সিপাল আমাদের পরীক্ষার হলে যেতে দেয়নি। বরং একটি আলাদা কক্ষে নিয়ে যায়, এবং হিজাব পরার কারণে রুমের ভিতরে তালাবদ্ধ করে দেয়।”
“আমরা ক্লাসে ২৪ জন মুসলিম শিক্ষার্থী এবং পুরো ব্যাচে ৩০ জন। প্রিন্সিপাল আমাদের পরীক্ষা এবং হিজাবের মধ্যে যেকোন একটি বেছে নিতে বাধ্য করে। আমরা আমাদের হিজাব খুলতে অস্বীকার করায়, সে আমাদের কলেজ ছেড়ে যেতে বলে। এবং আমাদের সাথে খুব অভদ্রতার আচেরণ করে। কিছু মুসলিম মেয়ের বাবা-মা আমাদের সমর্থন করেছিলেন এবং প্রিন্সিপালকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে কারো আবদার রাখেনি। হিন্দু শিক্ষক বা শিক্ষার্থী কেউই আমাদের সমর্থন করেনি। এটা আমাদের জন্য খুবই অপমানজনক ছিল। আমরা স্কুল ছেড়ে দিয়েছি, কারণ আমরা হিজাব এবং শিক্ষার মধ্যে যেকোন একটিকে বেছে নিতে পারি না। দুটোই আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
শিক্ষার্থীদের এক অভিবাবক বলেছেন, “হিজাব আমাদের ধর্মের ফরজ বিধান এবং আমরা অবশ্যই এর সাথে কোন ধরণের আপস করতে দিব না। হিজাব খুলে ফেলা আমাদের শালীনতা থেকে বেরিয়ে আসার সমান। আমি আমার মেয়েকে আর সেই স্কুলে পাঠাব না, যদি তারা হিজাব খুলে ফেলতে বলে, আমি তার পরিবর্তে তাকে আরবি স্কুলে ভর্তি করে দেবো।”
“আমি চাই আমার মেয়ে মান্ডিয়ার মুসকান খান নামের সেই মেয়েটির মতো সাহসী হোক, যে গেরুয়া সন্ত্রাসীদের অপমানের জবাবে আল্লাহু আকবর স্লোগান তুলেছিল। আমরা যতই সমস্যার সম্মুখীন হউক না কেন, আমি আমার মেয়েকে তার হিজাব খুলতে দেব না।”
এদিকে ভারতের কোডাগুর নেলি হুদিকেরির একটি পাবলিক স্কুলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের তাদের হিজাব নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিতে অস্বীকার করায় প্রায় ৩০ জন শিক্ষার্থী বাড়িতে ফিরে গেছে।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে, হিজাব পড়ে ছাত্রীরা স্কুলে প্রবেশ করতে না পারায় তাদের মা-বাবারাও কর্তৃপক্ষের সাথে তর্ক-বিতর্ক করছেন। অনেকক্ষণ তর্ক-বিতর্ক করার পর অবশেষে বাধ্য হয়ে কিছু মুসলিম ছাত্রীরা তাদের হিজাব খুলে ফেলেন এবং শুধুমাত্র মাস্ক পরে স্কুলে প্রবেশ করেন।
কর্ণাটকের উদুপি এবং শিভামগ্গা জেলার স্কুলের দুই শিক্ষার্থী হিজাব খুলে পরীক্ষায় বসতে রাজি হননি। তাদের মধ্যে একজন ছাত্রীর অভিভাবক এনডিটিভিকে বলেছেন, “হিজাব খুলে না ফেললে পুলিশের ভয় দেখিয়েছেন স্কুলের শিক্ষকরা।”
উদুপির সরকারি একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ওই ছাত্রীর অভিভাবক আরো বলেছেন, “এ ধরনের (হিজাব নিষিদ্ধ) ঘটনা আগে ঘটেনি। আমাদের সন্তানকে আলাদা ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। সোমবার শিক্ষকরা বাচ্চাদের ভয় দেখিয়েছেন।”
তিনি আরো বলেছেন, “শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বলেছে, ‘যারা হিজাব পরে আছ, বাইরে যাও; যারা হিজাব ছাড়া আছ তারা ক্লাসে বসো।’…আমাদের সন্তানরা হিজাব পরতে চায় এবং তারা শিক্ষালাভ করতে চায়। হিন্দু শিক্ষার্থীরা সিঁদুর পরে এবং খ্রিস্টানরা জঁপমালা পরে; আমাদের সন্তানরা হিজাব পরলে দোষটা কোথায়?”
এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, কর্নাটকের শিবমোগা জেলার ১০ম শ্রেণীর ১৩ ছাত্রী, ৯ম শ্রেণীর দু’ছাত্রী এবং অষ্টম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে হিজাব ত্যাগ করতে না চাওয়ায় তাদেরকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে, নির্বাচনী উত্তাপের মাঝেই হিজাব বিতর্কে মুখ খুলেছে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ। তার বক্তব্য, শরীয়ত নয়, দেশের সংবিধান মেনে চলতে হবে। একইসাথে, ‘এই দেশে মৌলবাদের শাসন কোনো দিন স্থাপন হবে না’– বলেও সে মন্তব্য করে।
তথ্যসূত্র:
১। Principal made us choose between hijab and exam: Muslim students in Karnataka
https://tinyurl.com/y2fw5bv7
২। হিজাব ত্যাগ করো, অন্যাথায় বাড়ি ফিরে যাও
https://tinyurl.com/2p9xzu9a
৩।শরীয়ত নয়, সংবিধান মানতে হবে : যোগী
https://tinyurl.com/58mrzxzd
৪। হিজাব খুলতে বলায় কর্নাটকের দুই স্কুলছাত্রীর পরীক্ষা বয়কট
https://tinyurl.com/yckv2ckn