গতকাল ছিল ১৩ জুলাই। ১৯৪৯ সাল থেকে এই দিনটি আনুষ্ঠানিকভাবে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। তবে ২০১৯ সালে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের পর নয়াদিল্লি এই দিনটিকে সরকারী ছুটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেয়। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর হিন্দুত্ববাদী সরকার যে কয়টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম।
এই দিনটিকে কাশ্মীরি জনগণ রাজনৈতিক জাগরণের সূচনা হিসাবে স্মরণ করে থাকে। ১৯৩১ সালের এদিন স্বৈরাচারী রাজার বাহিনীর হাতে ২২ জন কাশ্মীরি মুসলিম নিহত হন।
১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই, আব্দুল কাদিরের মামলার শুনানির সময় শ্রীনগরে আদালতের বাইরে জড়ো হওয়া মানুষদের উপর ডোগরা বাহিনী গুলি চালায়। আব্দুল কাদিরের বিরুদ্ধে একটি কথিত “উস্কানিমূলক বক্তৃতা” দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল। মূলত কাদিরের এই বক্তব্য ছিল প্রিন্সলি স্টেটের কয়েকটি মুসলিম-বিরোধী ঘটনার পটভূমি থেকে। কাশ্মীর চার শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বিদেশী শাসনের অধীনে ছিল। মুঘল ও আফগানদের পর শিখ এবং সবশেষে ডোগরারা যারা- ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চলটিকে কেনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ পায়।
তবে ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই প্রথম কাশ্মীরিরা কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কাশ্মিরি রাজনীতিবিদ ও পণ্ডিত প্রেম নাথ বাজাজের মতে, এই আন্দোলনের পেছনে মূল কারণ ছিল মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ। এবং এই দিনই কাশ্মীরে সবচেয়ে আধুনিক অর্থে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু হয়।
তখন থেকে এই দিনটি বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মীরের মুসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৪৮ সালে এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। দিনটি কেবল কাশ্মীরের রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সকল ধারার রাজনৈতিক মহলেও দিনটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি গনতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদরাও ১৯৩১ সালের ১৩ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে কাশ্মীরের ভারতে যোগদান করাকে দেখেন। তবে প্রতিরোধ বাহিনীগুলো মনে করে- কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৩১ সালের ১৩ ই জুলাই শুরু হয়েছিল, যা এখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেনি।
দিনটিকে শ্রীনগরের শহরতলী এলাকায় একটি বড় মিছিল দ্বারা পালন করা হয়। এই মিছিলগুলো বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে শুরু হয়ে নওহাটা এলাকার নকশব্ন্দসাহেবের মাজারে শহীদদের কবরস্থানে গিয়ে শেষ হয়, যেখানে ১৯৩১ সালের শহীদদের দাফন করা হয়।
উপত্যকার চারপাশের লোকেরা তাদের রাজনৈতিক পছন্দের উপর নির্ভর করে এই মিছিলগুলির মধ্যে থেকে একটিতে যোগ দেয়। লোকেরা এই মিছিলগুলি দেখার জন্য শহরের কেন্দ্রস্থলে বসবাসকারী তাদের আত্মীয়দের সাথেও দেখা করতে যায়।
সকালে মিরওয়াইজের নেতৃত্বের মিছিলটি জামিয়া মসজিদ থেকে শুরু হয়ে শহীদদের কবরে গিয়ে শেষ হয়। এরপরে বিকেলে বৃহত্তর জাতীয় সম্মেলনের মিছিল অনুষ্ঠিত হয় এবং এটি জয়না কাদালের তৎকালীন এনসি (ন্যাশনাল কনফারেন্স) সদর দপ্তর থেকে শহীদের কবর পর্যন্ত শুরু হয়। মিছিলটি সাধারণত শেখ আবদুল্লাহ এবং পরবর্তী বছরগুলিতে তার ছেলের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। মিছিলগুলিতে দলীয় স্লোগান থাকতো, থাকতো শক্তি প্রদর্শন। দিনটি কখনও তার প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি, কেবল এটির দর্শন বদলে যায়।
স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের পর, দিনটি স্বাধীনতাকামী আখ্যানের সাথে আরও সংযুক্ত হয়ে ওঠে এবং উপত্যকাটি যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল এবং এখনও যাচ্ছে তার সূচনা হিসাবে চিত্রিত করা হয়। গণতন্ত্রী ধারার কথা বলতে গেলে, দিনটি এখন সরকারী বিবৃতি এবং কবর পরিদর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, মূলধারার নেতারা এখন শুধু শহীদদের কবরগুলি পরিদর্শন করে। অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী ও প্রতিরোধ বাহিনীগুলোর জন্য দিনটি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও স্বাধীনতার আহবান জানানোর অন্যতম উপলক্ষ হয়ে উঠে।
তবে ২০২০ সালে বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর দিনটি আর আনুষ্ঠানিক রাখা হয়নি। যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার এই অঞ্চলের কার্যাবলীর শীর্ষে, তাই তারা এই অঞ্চল এবং এর জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং করে যাচ্ছে। এমন সব সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছে যেখানে কাশ্মীরি জনগণদের বা তাদের প্রতিনিধিদের কোনওভাবেই কোনও বক্তব্য গৃহীত হয় না।
বিশেষ মর্যাদা বাতিল থেকে শুরু করে অধিবাস আইন, ভূমিমালিক আইন, চুক্তি, প্রায় সবকিছুই তারা চায়। এমনকি কাশ্মীরিদের আবেগককে উপেক্ষা করে এই বিশেষ দিনটিকে ছুটির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ভারতের সাথে অধিভুক্তির দিনটিকে তারা ছুটির দিনের তালিকায় যুক্ত করে।
এত কিছু সত্ত্বেও, এই দিনটি সকল ধারার লোকেরা তাদের নিজস্ব ভঙ্গিতে স্মরণ করে। গত বছরের মতো এ বছরও কাউকে শহীদদের কবর জিয়ারত করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবে স্বাধীনতাকামীদের জন্য দিনটি তাদের সংগ্রামের একটি স্মারক।
দিনটি আজীবন তার তাৎপর্য এবং ইতিহাসের জন্য কাশ্মীরিদের মাঝে একটি আলাদা স্থান নিয়ে থাকবে। যদিও তাদেরকে হিন্দুত্ববাদী সরকার এটি স্মরণ করার অনুমতি দিবে না, তবুও তারা এই দিনটি মনে রাখবে।
তথ্যসূত্র:
——–
1. 13 July: Kashmir’s martyrs day India wants to forget
– https://tinyurl.com/4j7ck4yn