পূর্বকথা
প্রথম পর্বে আমরা টিআইপির সূচনা, ঐতিহাসিক পটভূমি ও চিনাদের বিরুদ্ধে তাদের কিছু অভিযানের ব্যপারে আলোকপাত করেছিলাম। প্রায় সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কারাবন্দি হওয়ার পর টিআইপি’র উপর যে বিলুপ্তপ্রায় বা বিপর্যয়কোর অবস্থা নেমে আসে, সেবিষয়ে আমরা প্রথম পর্বের ইতি টেনেছিলাম।
আজকের দ্বিতীয় পর্বে আমরা শায়েখ হাসান মাহসুমের নেতৃত্বে টিটিপির ঘুরে দাঁড়ানো ও সক্ষমতা অর্জনের বর্ণনা পেশ করবো ইনশাআল্লাহ্।
হাসান মাহসুম: আধুনিকায়ন ও সংস্কারের অগ্রনায়ক
ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টির বর্তমান আধুনিক রূপ এর পিছনে মূল অবদান শায়েখ হাসান মাহসুমের। তিনি চীনের হাতে বারবার কারাবরণের পর উপলব্ধি করেন যে, জিনজিয়াং তথা পূর্ব-তুর্কিস্তানে থেকে টিআইপিকে নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব না। তাই তিনি টিআইপিকে পুনরায় সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে পূর্ব-তুর্কিস্তান ত্যাগ করেন।
এসময় তিনি সৌদি আরব, পাকিস্তান এবং তুরস্কে বসবাসরত প্রভাবশালী উইঘুর ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত উইঘুরদের কাছে সাহায্যের জন্য যান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পরাজিত মানসিকতা তাদের আচ্ছাদিত করে ফেলায় তারা চীনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদকে ব্যর্থ উদ্যোগ বা ভুল পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করে এবং হাসান মাহসুমকে জিহাদ ছেড়ে দিয়ে উন্নত জীবনের সন্ধানে অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমাতে বলে। হাসান মাহসুম তাদের কথায় ব্যথিত হয়ে ১৯৯৭ সালে হজ পালন শেষে চলে আসেন সাম্রাজ্যবাদীদের গোরস্তান খ্যাত আফগানিস্তানে। এখানে তিনি আবদুল কাদির ইয়াপুকুয়ান এবং আরো কিছু সঙ্গি-সাথী নিয়ে টিআইপির পুরো কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন।
এতদিন যাবত টিআইপি বারিন বিদ্রোহের মূল নায়ক জিয়া উদ-দ্বীন এর চিন্তাধারা ও মতাদর্শ অনুসরণ করতো। সেই অনুযায়ী শুধু উইঘুরদেরকেই টিআইপির সাথে সম্পৃক্ত করা হতো। হাসান মাহসুম তা বাতিল করে সমস্ত তুর্কিদের টিআইপির পতাকাতলে সমবেত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সাথে শুধুমাত্র পূর্ব তুর্কিস্তান বা জিনজিয়াং অঞ্চলে টিআইপির কার্যালয়, মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করাকে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে টিআইপির হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।
তিনি বৈশ্বিক জিহাদি আন্দোলনের কর্ণধার তানযিম আল কয়েদার সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াশ চালান এবং তাদের কাছ থেকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য লাভ করতে সক্ষম হন।
এভাবে জিনজিয়াং (পূর্ব-তুর্কিস্তান) এবং মধ্য এশিয়া ছাড়াও আফগানিস্তান ও পাকিস্তান অঞ্চলে উইঘুর মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ শিবির ছড়িয়ে দেয়া হয়। ’৯০ এর দশক শেষ হবার আগেই আফগানিস্তানের খোস্ত, বাগরাম, কাবুল এবং হেরাত প্রদেশ জুড়ে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপনের কাজ সমাপ্ত করে টিআইপি।
তবে টিআইপিকে আধুনিক রূপ দানকারী শায়েখ হাসান মাখদুম ২০০৩ সালে পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াযিরিস্তান প্রদেশের আংগুর-আডডা এলাকায় পাকিস্তান ও আমেরিকার সম্মিলিত এক সামরিক অভিযানে শাহাদাতবরণ করেন।
আধুনিক তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি
হাসান মাখদুমের তৎপরতায় ও প্রচেষ্টায় টিআইপি পাক-আফগান অঞ্চলে প্রভাবশালী অবস্থান তৈরিতে সক্ষম হয়। তাঁর শাহাদাতের পর টিআইপির নেতৃত্বের হাল ধরেন শায়েখ আব্দুল হক আত-তুর্কিস্তানী, যিনি বর্তমান সময় পর্যন্ত টিআইপির নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আল-কায়েদা এবং তালিবান উভয় জামাআতের সাথে সম্পর্ক রাখা অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। ২০০৫ সালে তাকে আল-কাইদার শুরা কাউন্সিলে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যপারে শনা গিয়েছিল। তাছাড়া তালিবানের বিভিন্ন গোত্রীয় যোদ্ধাদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের ব্যাপারটিও প্রসিদ্ধ। ২০০৯ সালে তিনি তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তানের প্রাক্তন আমীর বাইতুল্লাহ মেহসুদ এর সাথে পাকিস্তানের গোত্রীয় এলাকায় মজলিসে অংশ নিয়েছেন। সেই বছরেরই আগস্টে তিনি বিশ্বজুড়ে চীনের দূতাবাসগুলোতে হামলার হুমকি প্রদান করেন। জিহাদি কার্যক্রমে দক্ষতার কারণে সাপের মাথা আমেরিকা তাকে স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেররিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে।
২০১০ সালে আমেরিকা ঘোষণা দেয় তারা পাকিস্তানের উত্তর ওয়াযিরিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়ে আব্দুল হককে শহীদ করে দিয়েছে। কিন্তু টিআইপি এই ব্যাপারে নীরব থাকে। আসলে আব্দুল হক ড্রোন হামলায় আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে যান, তবে তিনি হামলায় আহত হন। টিআইপি এরকম ড্রোন হামলায় আব্দুল হকের মত আরও একজন দক্ষ নেতাকে হারাতে চাইছিল না। তাই আব্দু শাকুর নামে অপর একজন নেতাকে দলের নেতৃত্ব অর্পন করা হয়, যাতে করে আব্দুল হক শহীদ হয়েছেন – এরকম একটি ঘটনাপ্রবাহ তৈরি করা যায়।
আব্দু শাকুর পাকিস্তানের গোত্রীয় এলাকায় আল-কায়েদার মুজাহিদদের নেতৃত্ব দিতেন। উযবেকিস্তানের জিহাদি দল এবং তালিবানের বিভিন্ন উপদলের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, যা তাকে পরিণত করেছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে। ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তিনি ২০১১ সালে কাশগড় ও হোতান অঞ্চলে টিআইপির মুজাহিদদের পরিচালিত ৪টি হামলার দায় স্বীকার করেন। কিন্তু তিনিও ২০১২ সালে পাকিস্তানের শাওয়াল উপত্যকায় আমেরিকার ড্রোন হামলায় শাহাদাতবরণ করেন। এরপর টিআইপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ মানসুর।
তার নেতৃত্বকালীন সময়ে টিআইপি প্রতিনিয়ত চীন সরকারের বিরুদ্ধে চালানো হামলা সমূহের প্রশংসা করে ভিডিও বার্তা প্রকাশ করতে থাকে। ২০১৩ সালে আব্দুল্লাহ মানসুর তিয়ানামেন স্কয়ারের হামলার দায় স্বীকার করেন। হামলার ফলে ৫ চীনা নিহত ও ৩৮ জন আহত হয়েছিল। এরপর ২০১৪ সালে তিনি কুনমিং রেলস্টেশনে বিক্ষুব্ধ উইঘুরদের চালানো হামলার প্রশংসা করেন, যে হামলার ফলে ৩১ জন চাইনিজ নিহত ও প্রায় দেড়শত আহত হয়।
এরপর, কুফফারদের বিস্মিত করে ২০১৫ সালের জুন মাসে এক ভিডিও বার্তায় নিজের উপস্থিতি ও সুস্থতার জানান দেন শায়েখ আব্দুল হক (হাফি.)। একই সাথে তিনি পুনরায় টিআইপির নেতৃত্ব গ্রহণের ঘোষণা দেন। সেই থেকে শায়েখ আব্দুল হক টিআইপির নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ২০২২ সালের মে মাসে দলটির মিডিয়া আব্দুল হক, আব্দুস সালাম আত-তুর্কিস্তানী এবং অন্যান্য সদস্যদের ইদুল ফিতর উদযাপনের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে।
সামরিক ও মিডিয়া বিভাগের সক্ষমতা:
তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি নিজেদের সামরিক সক্ষমতার ব্যাপারে সবসময়ই গোপনীয়তা অবলম্বন করেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক রিপোর্ট মোতাবেক, আফগানিস্তানের কুন্দুজ, বাদাখশান এবং তাখার প্রদেশে অন্তত ৫০০ যোদ্ধা প্রস্তুত রয়েছেন তাদের।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এই তথ্য হালনাগাদ করে বলা হয়, আফগানিস্তানে অন্তত ৭০০ জন টিআইপি যোদ্ধা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন ও চীন-সংশ্লিষ্ট টার্গেটসমূহে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু কোনো রিপোর্টেই নিরাপত্তা কাউন্সিল যোদ্ধাদের প্রকৃত সংখ্যা উল্লেখ করতে পারেনি। এক সাক্ষাৎকারে টিআইপির প্রতিনিধিকে যোদ্ধাদের সংখ্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি।
কথিত আছে, টিআইপি বাঘলান প্রদেশ থেকে দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং পুরো সংগঠনের কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলেও পূর্বোল্লেখিত রিপোর্টটিতে বর্ণনা করা হয়। বর্তমানে দলটির আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শায়েখ আব্দুল হক, নায়েবে আমির হিসেবে আছেন শায়েখ আব্দুসসালাম আত-তুর্কিস্তানী, সামরিক কমান্ডার হিসেবে আছেন হাজি ফুরকান এবং সুপ্রিম শুরা কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে আছেন যায়িতি এবং ইবিনি মুহাইমিদ (হাফিযাহুমুল্লাহ)।
টিআইপির মিডিয়া চ্যানেল “ইসলাম আওয়াযি/ভয়েস অফ ইসলাম” মিডিয়ায় সকল বিবৃতি, ছবি এবং ভিডিও উইঘুর ও আরবি ভাষায় প্রকাশ করা হয়।
সিরিয়া যুদ্ধে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি:
সিরিয়ায় আসাদ-রাশিয়া-ইরানি জোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদেশী যোদ্ধাদের দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় জিহাদি দল তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২০২২ সালের এক রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী শুধু ইদলিবেই টিআইপির দুই হাজারের কাছাকাছি যোদ্ধা রয়েছে।
সিরিয়ায় টিআইপি হিজবুল ইসলাম আত-তুর্কিস্তান নামে পরিচালিত হচ্ছে। সিরিয়ার ইদলিব, লাতাকিয়া এবং হামা প্রদেশে অন্যান্য বিদ্রোহী দলের সাথে মিলে দলটির মুজাহিদরা জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কাতিবা আত তুর্কিস্তানের আছে অত্যন্ত কার্যকর আধুনিক অস্ত্রের মজুদ। সিরিয়ার হাসাকাহ, ইদলিব, হালাব (আলেপ্পো), লাতাকিয়া এবং হামা প্রদেশসমূহে আসাদ জোটের বিরুদ্ধে জটিল এক যুদ্ধক্ষেত্রে দলটির যোদ্ধারা ইসতেশহাদি হামলাও পরিচালনা করেছেন। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি সিরিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন সময় জিহাদি দলগুলোর মাঝে সংকট নিরসনে তারা ভূমিকা রেখে চলেছেন।
উত্তর সিরিয়ায় হাইআতু তাহরির আশ শামের একচেটিয়া প্রভাব থাকা স্বত্তেও তারা কাতিবাত আত তুর্কিস্তানকে ভেঙে দিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারেনি।
আগের পর্ব পড়ুন:
১। তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্টি: চীনা হায়েনাদের বিরুদ্ধে অদম্য এক প্রতিরোধ আন্দোলন [পর্ব-১]
– https://alfirdaws.org/2023/03/02/62560/
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ্, প্রিয় কোনো ভাই যদি কমেন্টে তুর্কিস্তান ইসলামিক পার্ট ও সিরিয়ার আনসার আল ইসলাম সহ অন্যন্য দলগুলোর ওয়েবসাইটের আপডেট লিংক শেয়ার করতেন, উপকৃত হতাম (জাজাকাল্লাহু খায়রান)
টিআইপি সিরিজ কি দুই পর্বেই সমাপ্ত? আর কোনো পর্ব কি আসবে?