সাহাবাগণ রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন ঈমানে, ইলমে ও আমলে ছিলেন সুমহান। কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের প্রশংসাবাণী। আল্লাহ তাআলা ছিলেন তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট। তাঁদের যুগ ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ যুগ।
এতকিছু সত্ত্বেও তাঁরা নিজেদের ব্যাপারে নিফাকির ভয় করতেন। নিফাকের ব্যাপারে আতঙ্কে থাকতেন। ইবনে আবু মুলাইকা একজন তাবেঈ ছিলেন। তিনি বলেন, আমি ত্রিশজন সাহাবীর দেখা পেয়েছি। তাঁরা সকলে নিজের ব্যাপারে নিফাকির ভয় করতেন।
কেবল মুমিনরাই নিফাকির ব্যাপারে ভয় করে, আর কেবল মুনাফিকরাই নিফাকির ব্যাপারে নির্ভিক থাকে। সত্যিকার মুমিন নিজের ব্যাপারে নিফাকির ভয় করে। আর যে নিফাকির ভয় করে না সে-ই মুনাফিক। যদি আমাদের কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনি কি নিফাকির ভয় করেন? তাহলে এমন প্রশ্নই আমাদের কাছে অপরিচিত ও অপছন্দনীয় মনে হবে। আমি কীভাবে মুনাফিক হব? আমি নামায পড়ি, রোযা রাখি, আত্মশুদ্ধি করি, হজ্জ করি, সাদাকা দিই। আমাদের অন্তরে নিফাকির ভয় জাগ্রত হয় না। অথচ সাহাবাগণ নিজেদের ব্যাপারে নিফাকির ভয় করতেন।
নিফাক কাকে বলে? ইমাম হাসান আল-বসরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিফাকের হাকীকত ও বাস্তবতা স্পষ্ট করেছেন এভাবে,
“النفاق هو اختلاف السر مع العلانية واختلاف القول مع العمل”.
অর্থ: নিফাক হচ্ছে, প্রকাশ্য অবস্থার সাথে গোপন অবস্থার এবং কাজের সাথে কথার অমিল।
এই মূলনীতির আলোকে, ভয়ানক এই বিষয়ে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেকে যাচাই করা। যখন কোনও ব্যক্তির প্রকাশ্য অবস্থার সাথে গোপন অবস্থার অমিল হবে অর্থাৎ, মানুষের সাথে সে খুব মুত্তাকী। বাহ্যিকভাবে দ্বীনদারি, দৃঢ়তা ও ইসলামী শিক্ষাকে আঁকড়ে ধারণ করার ভান করে। আর যখন জনমানুষ থেকে পৃথক হয় তখন একাকী গুনাহ, অশ্লীলতা ও অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত হয়। যদি আপনার প্রকাশ্য অবস্থার সাথে গোপন অবস্থার বা জাহেরের সাথে বাতেনের অমিল হয় তাহলে ইমাম হাসান আল-বসরীর ভাষ্যমতে এটা-ই নিফাকি। আল্লাহর কাছে পানাহ চাই।
অনুরূপভাবে কাজের সাথে কথার অমিলও নিফাকির আলামত। মুখে যা বলি তা আমলে পরিণত না করাও নিফাকির আওতাধীন। এই মূলনীতির আলোকে নিজেকে যাচাই করব। কত মানুষ খুতবা প্রদান করে, দারস দেয়, মানুষকে আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে; অথচ তারাই সেই আমল থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لَا تَفْعَلُونَ*كَبُرَ مَقْتاً عِندَ اللَّهِ أَن تَقُولُوا مَا لَا تَفْعَلُونَ.
অর্থ: হে মুমিনগণ, তোমরা যা কর না সে সম্পর্কে কেন কথা বল। যা কর না সে সম্পর্কে কথা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক কাজ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিফাকির কিছু আলামত বর্ণনা করেছেন। মুনাফিকের আলামত হচ্ছে, “মিথ্যা বলা, আমানতের খেয়ানত করা, ওয়াদা ভঙ্গ করা ও গালিগালাজ করা”। এগুলো মুনাফিকের লক্ষণ। তাই এগুলো থেকে সাবধান থাকতে হবে। মিথ্যা বলা তো কিছু মানুষের ব্যক্তিত্ব ও দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে যায়। বিশেষ করে কিছু ব্যবসায়ীর অবস্থা হচ্ছে, তারা সব সময় মিথ্যা বলে, খেয়ানত করে, ওয়াদা ভঙ্গ করে ও গালিগালাজ করে। আপনি তার কাছে আমানত রেখেছেন, শেয়ারে টাকা দিয়েছেন। তার কাছে সেই আমানত বা টাকা চাইলে বলবে, আপনি আমার কাছে কোনও আমানত বা টাকা দেননি। তার সাথে কোনও ওয়াদা করেছেন, পরবর্তীতে দেখবেন সে ওয়াদা ভঙ্গ করছে। তার সাথে যদি ঝগড়া করেন তাহলে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
কুরআনে মুনাফিকদের যে আলামতগুলো বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো থেকেও আমাদের সাবধান থাকতে হবে। তা হচ্ছে, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ ত্যাগ করা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُم مِّن بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ.
অর্থ: মুনাফিক নারী-পুরুষরা একে অপরের বন্ধু। তারা অসৎকাজের আদেশ করে এবং সৎকাজ থেকে নিষেধ করে।
এটা মুনাফিকদের সিফাত ও গুণ, আলামত ও বৈশিষ্ট্য যে, তারা সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে না। বরং এর উল্টোটা করে। এই বৈশিষ্ট্য আজ অনেক মুসলিমের মাঝেই বিদ্যমান। তারা নিজেরা নামায, রোযা, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি হুকুম পালন করেই ক্ষান্ত। কিন্তু, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করে না।
মুনাফিকদের আরেকটি নিদর্শন হচ্ছে, দ্বীনদার মুসলিমদের নিয়ে ঠাট্টা করা। বর্তমানে বহু স্যাটেলাইট চ্যানেল, পত্রিকা ও মিডিয়ার একমাত্র ও বৃহৎ লক্ষ্যই থাকে দ্বীনদার, মুজাহিদ, নেককার ও হকপন্থী উলামাদের ঠাট্টা করা। তারা টকশো করে। টকশোতে তাঁদেরকে নির্বোধ, বাস্তবতা বিবর্জিত ইত্যাদি আখ্যা দেয়। কখনও আবার মুজাহিদীন ও সালিহীনদের ভিলেন ও খলনায়ক বানিয়ে নাট্যাভিনয় ও মুভি নির্মাণ করে। এগুলো মুনাফিকদের নিদর্শন। সেক্যুলার মুসলিমদের মাঝে এই নিদর্শন পাওয়া যায়। তারা এক্ষেত্রে কাফেরদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। অনেক সেক্যুলারের প্রধান লক্ষ্যই থাকে দ্বীনদার, নেককার ও মুজাহিদিনের ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা।
কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুনাফিকদের আরেকটি আলামত উল্লেখ করেছেন, সময়মতো নামায আদায় না করা, নামায কাযা করা। ওযর ব্যতীত স্বাভাবিক অবস্থায় বিষয়টি খুব মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَوَيْلٌ لِّلْمُصَلِّينَ*الَّذِينَ هُمْ عَن صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ.
অর্থ: সেই নামাযীর ধ্বংস যে নামাযের ব্যাপারে অলস ও গাফেল।
অর্থাৎ, যারা শরঈ ওযর ব্যতীত নামায কাযা করে। সে অসুস্থ নয়, মুসাফিরও নয়। নামায কাযা করা মুনাফিকের আলামত। (وَيْلٌ) শব্দটি আযাবের অর্থদায়ক। মুনাফিকরা নামাযে অলসভাব ও লোকদেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়ায়। মুনাফিকরা লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়ে। আল্লাহ তাআলার জন্য নামায পড়ে না। নামাযের দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য থাকে খ্যতিলাভ, প্রশংসা কুঁড়ানো।
মুনাফিকদের আরেকটি আলামত হচ্ছে, তারা খুব অল্পই আল্লাহর যিকর করে। তাদের কথাবার্তায় আল্লাহর যিকর থাকে না। দৈনন্দিন জীবনে তিলাওয়াত ও যিকরের জন্য কোনও সময় বরাদ্দ থাকে না। তাদেরকে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর যিকর, তিলাওয়াত, দুরুদ পাঠ করতে দেখবেন না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে মুনাফিকদের এই আলামত উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
وَلاَ يَذْكُرُونَ اللّهَ إِلاَّ قَلِيلاً.
অর্থ: তারা অল্পই আল্লাহর যিকর করে।
প্রিয় দ্বীনি ভাই, আমাদের আদর্শ ও নেতা রাসূলে কারীম সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফিকদের আলামত উল্লেখ করেছেন, “জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ” ত্যাগ করা। সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“من مات ولم يغزُ أو يحدث نفسه بالغزو مات على شعبة من النفاق”
অর্থ: যে ব্যক্তি জিহাদ না করা বা জিহাদের প্রকৃত মনোবাঞ্ছা না থাকা অবস্থায় মারা গেল সে নিফাকির একটি শাখার উপর মারা গেল। (সহীহ মুসলিম, হাদিস নং-১৯১০)
এজন্য ইমাম নববী ও ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুমাল্লাহ বলেন, মুনাফিকের আলামত হচ্ছে জিহাদ ত্যাগ করা। নিফাকির একটি শাখা হচ্ছে জিহাদ ত্যাগ করা। আমাদেরকে মুনাফিকের আলামত থেকে বেঁচে থাকতে হবে। এমনকি নিফাকির অনুনয়-বিনয় থেকেও বেঁচে থাকতে হবে। হযরত আবু হুরায়রা ও হযরত আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, “তোমরা নিফাকির অনুনয়-বিনয় থেকে সাবধান হও”। জিজ্ঞাসা করা হলো, নিফাকির অনুনয়-বিনয় কী? তিনি বলেন,
“أن يُرى الجسد خاشعًا والقلب ليس بخاشع”
দেহে অনুনয়-বিনয়ের ভাব রাখা; অথচ অন্তর অনুনয়-বিনয় থেকে শূন্য।
মূল: শায়খ খালিদ আল-হুসাইনান (আবু যায়েদ কুয়েতি) রহমাতুল্লাহি আলাইহি
অনুবাদ: আল-ফিরদাউস টিম