বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমালোচিত হয়েছে বারবার। বিচারপতির আসনে বসে যখন যাকে খুশি আদালতে ডেকে অপমান-অপদস্থ করা, বিজনেস ক্লাসে বসতে না পেরে বিমানের ভেতর তুলকালাম, রাস্তায় সালাম না দেওয়ায় ট্রাফিক পুলিশকে আদালতে তলব, ২১ জন সিনিয়রকে ডিঙিয়ে পদোন্নতি, সরকারি বাড়িতে থেকে ভাড়া না দেওয়া, লন্ডনে বাড়ি কিনে আয়ের উৎস দেখাতে না পারা এবং সর্বশেষ টকশোতে গিয়ে উপস্থাপিকার সঙ্গে অশোভন আচরণসহ নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। এখানেই শেষ নয়, দখলবাজিতেও পিছিয়ে ছিল না সাবেক এই বিচারপতি। রাজধানীর বারিধারায় দুস্থ সাংবাদিকদের নামে ওয়াকফ করা প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ৫ একর জমি দখল করেছে সে। এরপর ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে গড়েছে সাতটি আটতলা ভবন।
খোঁজ নিয়ে কালবেলা জানায়, দুস্থ ও অসহায় সাংবাদিকদের পুনর্বাসনের জন্য ১৯৯৮ সালে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (জার) নামে একটি সংস্থাকে ঢাকার বারিধারায় ১০ একর জমি লিজ দেয় সরকার। এরপর ২৭ বছর পার হলেও সাংবাদিকরা জমির দখল পাননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরই ওই জমিতে নজর পড়ে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের। প্রভাব খাটিয়ে সেখান থেকে ৫ একর জমি দখলে নেয় সে। নথিপত্র অনুযায়ী, ১৮৮৫ সাল থেকে আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের মালিকানাধীন হলেও ভুয়া কাগজপত্র সৃজন করে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি দেখায় মানিক। এরপর ‘অ্যাডভান্স ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি কোম্পানিকে দিয়ে সেখানে তৈরি করে ৮ তলাবিশিষ্ট সাতটি ভবন। সব মিলিয়ে তৈরি হয় শতাধিক ফ্ল্যাট।
নথিপত্র বলছে, বারিধারার ওই জমিটি ১৯৯৮ সালে প্রথম লিজ পায় জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (জার)। সর্বশেষ ২০০৪ সালের ২০ নভেম্বর জমিটি ওই সংস্থার অনুকূলে ৯৯ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ৫ মার্চ বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয় থেকে এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
গেজেটে বলা হয়, ‘নিম্ন তপশিল বর্ণিত সম্পত্তি আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেট (ই.সি, নং-৪১১-সি) এর মালিকানাধীন সম্পত্তি। উক্ত সম্পত্তি ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে ওয়াকফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২-এর ৩৩ ধারা মোতাবেক স্মারক নং-৩প্রঃ/ঢাঃদঃ/২০২, তারিখ ২০-১১-২০০৪ মূলে জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার (জার)-এর অনুকূলে দীর্ঘ ৯৯ বছর মেয়াদি লিজ প্রদান করা হয়েছে।’
আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের প্রকল্প পরিচালক শাদরূল আহমেদ বলেন, ‘১৮৮৫ সাল থেকে এই জমি আইন উদ্দিন হায়দার ও ফয়জুন্নেছা ওয়াকফ এস্টেটের। দুস্থ সাংবাদিকদের নামে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখানে ডোবা ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিচারপতি মানিক এই জমি জোরপূর্বক দখল করে নেন। তিনি ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে এই জমি দখল করেন। আমরা জমি উদ্ধারের অনেক চেষ্টা করেও পারিনি। কেউ কোনো অভিযোগ দিলেই তাকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতেন মানিক। পরে ভয়ে আর কেউ মুখ খোলেননি।’
শামসুদ্দিন মানিক ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পরে তাকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পরে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হয়। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পদোন্নতি পায় মানিক। এ সময় জ্যেষ্ঠ ২১ জন বিচারককে ডিঙিয়ে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
বিচারপতি শামসুদ্দিন মানিকের বাংলাদেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব রয়েছে। সেখানে মানিকের একাধিক বাড়িও রয়েছে। ২০১২ সালে শামসুদ্দিন মানিক লন্ডনে তিনটি বাড়ি ক্রয় করে তার আয়ের উৎস দেখাতে পারেনি। এ ছাড়া লন্ডনে শামসুদ্দিন মানিক ও তার পরিবারের নামে আরও সম্পত্তি আছে বলেও জানা গেছে। ২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে সে হামলার শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া ২০১৫ সালে অবসর গ্রহণের পর লন্ডনে ফের হামলার শিকার হয়।
তথ্যসূত্র:
১. বিচারপতি মানিকের দখলে ৯০০ কোটি টাকার জমি – https://tinyurl.com/23aby389