শুরুতে প্রতিমন্ত্রী পরে পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পরই পুরো স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প ও কেনাকাটায় একক আধিপত্য গড়ে তোলে সাবেক আওয়ামী স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইকুইপমেন্ট, ওষুধ সরবরাহ, যন্ত্রপাতি কেনাকাটা এবং বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নমূলক কাজে ভাগ বসিয়ে হাতিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
আর বাবার মন্ত্রিত্বে ভর করে দাদাগিরি করে ছেলে রাহাত মালেক। এক্ষেত্রে ব্যবহার করে আওয়ামীপন্থি চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের। শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তিন বছরের কেনাকাটাতেই প্রায় ৭০ কোটি টাকা হাতিয়েছে এই মন্ত্রীপুত্র।
বাবা-ছেলের বিরুদ্ধে প্রায় শতকোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক সূত্রে জানা গেছে, জাহিদ মালেক হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এর মধ্যে ঢাকার গুলশানে আলিশান বাড়ি, বনানীতে ১৪ তলা বিটিএ টাওয়ার, মানিকগঞ্জ শহরে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন, সভা-সমাবেশ করার জন্য গড়েছে শুভ্র সেন্টার।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাহিদ মালেকের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। তবে তার আগেই সপরিবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় মালেক পরিবার।
ইডিসিএল কারখানার জমিকাণ্ড
সরকারি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কারখানা স্থাপনের জন্য মানিকগঞ্জে জায়গা নির্ধারণ করা হয়। যার অনেকটা একক সিদ্ধান্ত ছিল সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের।
গণমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, ২০২২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) প্রকল্পটি পাস হয়। এতে মোট ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের জন্য মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের মেঘশিমুল এলাকায় সাড়ে ৩১ একর জমি প্রস্তাব করা হয়। যেসব মৌজায় এসব জমি পড়েছে তার অধিকাংশই পরিবারের সদস্যদের নামে আগেই কিনে রাখে জাহিদ মালেক।
বিষয়টি ধরতে পেরে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় তৎকালীন জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আবদুল লতিফ। পরে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘তার দুর্নীতির বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। তবে এই প্রকল্পসহ অন্যান্য প্রকল্পও নতুন করে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’
শুধু মানিকগঞ্জেই মালেক পরিবারের নামে ছয় হাজার ৫৩ শতাংশ জমির তথ্য পেয়েছে দুদক। জেলার বিভিন্ন মৌজায় কেনা এসব জমির মধ্যে ৪৬টি দলিলে জাহিদ মালেকের নামেই রয়েছে দুই হাজার ১৯৩ দশমিক ০৫৩ শতাংশ।
৯১টি দলিলে ছেলে রাহাত মালেকের নামে ১ হাজার ৭৪২ দশমিক ০১৬ শতাংশ এবং ২২টি দলিলে মেয়ে সিনথিয়া মালেকের নামে রয়েছে ১ হাজার ১১৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ জমি। বিপুল পরিমাণ এই জমির বাজারমূল্য হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা দুদক কর্মকর্তাদের।
করোনায় ৩৫০ কোটি টাকার অনিয়ম
সরকারি আইন ও বিধি না মেনে ২০২০ সালে ৩৫০ কোটি টাকার জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সুরক্ষা সামগ্রী কেনা হয়। পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা) না মেনেই এসব কেনাকাটা করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় পণ্যের মান নিশ্চিত করার বিষয়টি দেখেনি সংশ্লিষ্টরা। প্রায় প্রতিটি পণ্য ও যন্ত্র বাজারদরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে কেনা হয়। তদন্ত ও অডিটে বিষয়টি ধরা পড়ে।
কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি) সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রকোপ শুরু হলে ওই বছরের জুনে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার কোভিড-১৯ সামগ্রী কেনার পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে ৩৪৪ কোটি টাকা চুক্তিমূল্যে আরটি-পিসিআর, মাস্কসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি কেনা হয়।
সে সময় সিএমএসডির পরিচালক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শহীদুল্লাহ। অভিযোগ রয়েছে, এসব কেনাকাটায় রফাদফা হতো সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফোনে। আর মূলে ছিল স্বাস্থ্যের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজজেরুল ওরফে মিঠু।
গত রোববার (১৯ জানুয়ারি) একাধিক ঠিকাদার আমার দেশকে জানিয়েছে, কেনাকাটায় চুক্তি বলতে তখন কিছুই ছিল না। সিএমএসডির তৎকালীন পরিচালক মুঠোফোনে বলে দিত কাজ হয়ে যেত।
বাবা-ছেলের শতাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট
গত ১২ ডিসেম্বর জাহিদ মালেকের বিরুদ্ধে ৬১ কোটি ও ছেলে রাহাতের বিরুদ্ধে ১২ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক।
রাহাতের পকেটে ৭০ কোটি
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনকাটায় রীতিমতো সাগরচুরির ঘটনা ঘটেছে। গত তিন অর্থবছরে ৩১৮ কোটি টাকার বেশি যন্ত্রপাতি ও সুরক্ষা সামগ্রী কেনাকাটায় বরাদ্দ বাণিজ্যের মাধ্যমে হাতানো হয়েছে ৮০ কোটি টাকার বেশি। যে অপকর্মের মূলে জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক (শুভ্র)।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, করোনা মহামারিতে ২০২০ সালে হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয় সিএমএসডির মাধ্যমে। তৎকালীন সিএমএসডির পরিচালক মোর্শেদ জামান দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়ায় তাকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় সে সময়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তাতেও কাজ না হওয়ায় কেনাকাটার সব দায়িত্ব অধিদপ্তরের অধীনে করার নির্দেশ দেয় সে। এরপর থেকেই নিজের নামে কোনো কোম্পানি না থাকলেও কেনাকাটার সবটাই নিয়ন্ত্রিত হতো রাহাতের হাত ধরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত তিন বছরে ৩১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৫৮ হাজার ৬৮৮ টাকার যন্ত্রপাতি কেনাকাটা হয়েছে। এসব কেনাকাটার ৯০ ভাগ হয়েছে সাবেক লাইন ডিরেক্টর মাজহারুল হক তপনের নেতৃত্বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানিয়েছে, কারা কাজ পাবেন সেটি নির্ধারণ করে দিত রাহাত। নির্দিষ্ট কোম্পানি ছাড়া দরপত্রে কেউ যাতে অংশ নিতে না পারে, সে অনুযায়ী স্পেসিফিকেশন তৈরি করতেন লাইন ডিরেক্টর তপন।
ফলে ঘুরেফিরে ২৮ ঠিকাদার কোম্পানি বারবার কাজ পেয়েছে। কাজ পাওয়া প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমিশন নেওয়া হতো। এভাবে প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতানো হয়েছে। যার ৭০ কোটি গেছে রাহাতের পকেটে। আর অন্তত ১০ কোটি পায় তপন। লেনদেনের এসব টাকা রাহাতের বারিধারার বাসা, বনানীর অফিস এবং গুলশানের একটি পার্কে তৃতীয় পক্ষের একজন বস্তা ভরে গাড়িতে রেখে আসত।
সহযোগিতায় অধিদপ্তরের চার কর্মকর্তা
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মালেকপুত্রের এমন ভয়াবহ দুর্নীতির প্রধান সঙ্গী ছিল লাইন ডিরেক্টর তপন। গত বছরের শুরুতে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে সরানো হয়। একই পদে বসে অধিদপ্তরের সাবেক সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। সে জড়িয়ে পড়ে বরাদ্দ বাণিজ্যে। এ দুই কর্মকর্তাই আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) শীর্ষ নেতা।
আরো বড় অভিযোগ, এসব অনিয়ম জেনেও পদ বাঁচাতে চুপ ছিল তৎকালীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মুহাম্মদ খুরশীদ আলম। এতে সহায়তা করেছে সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম সাদী। এর মধ্যে সাদীর বিরুদ্ধেও অধিদপ্তরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ ও কেনাকাটায় অনিয়মে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোয় তা কখনোই তদন্ত হয়নি।
তথ্যসূত্র:
১. বাবা-ছেলের নিয়ন্ত্রণে ছিল স্বাস্থ্যের কেনাকাটা
– https://tinyurl.com/2zmxs7rb