
স্ত্রী আওয়ামী লীগের নেত্রী আর স্বামী নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক নেতা। এখন এই স্বামী-স্ত্রীর কাছে জিম্মি নিউ মার্কেটের হাজার হাজার ব্যবসায়ী। দোকান দখল, কাউকে চাঁদা দিতে বাধ্য করা, কথা না শুনলে করা হয় মারধর—এমন অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে এই জুটির বিরুদ্ধে। তাদের যৌথ চাঁদাবাজিতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত বছরের ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত নিউ মার্কেট ও তার আশপাশের এলাকায় একচ্ছত্র চাঁদবাজি করেছে জান্নাত জাহান চামেলি ওরফে লুনা হোসেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখন এসব এলাকা থেকে চাঁদা আদায় করছেন তার স্বামী নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মকবুল হোসেন। তাদের ভয়ে এখন মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না সাধারণ ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী নেতারাও তাদের ভয়ে তটস্থ। মকবুল চাঁদাবাজি করার ক্ষেত্রে নাম ব্যবহার করছে বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের।
বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাই এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যম জানিয়েছে, রাজনৈতিক আধিপত্য ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে বিগত ফ্যাসিস্ট শাসনামলে নিউ মার্কেট এলাকার ত্রাস ছিল যুব মহিলা লীগ নেত্রী লুনা। সে ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা (বর্তমানে কারাবন্দি) আমির হোসেন আমুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে। সে নিউ মার্কেটের সমবায় শিল্প সমিতির মালিকানাধীন কমপক্ষে ৯টি দোকান দখলে রেখেছিল। এছাড়াও লুনা জাল চুক্তিনামা করে ২০১৪ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন ২৬১ ও ২৬২ (কিছু অংশ) নম্বর দোকান দখলে নেয়। দোকানগুলো ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সমবায় অধিদপ্তর ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানেনি লুনা। এছাড়া তার কথার অবাধ্য হলেই মারধর করা হতো ব্যবসায়ীদের।
লুনার মারধরের শিকার ব্যবসায়ী বিপ্লব কুমার দাস। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে আমাকে মারধর করে দোকান দখল নিয়ে নেয় লুনা। সিআইডি ঘটনার প্রমাণ পেয়ে আমাদের পক্ষে রিপোর্ট দিয়েছিল। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয় আমাদের দোকান বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সিটি করপোরশেনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ওই দোকান আর বুঝিয়ে দেয়নি। এখন তো আর দোকান ফিরে পাওয়ার আশাই নেই। কারণ দোকানের বাকি অংশগুলো এখন দখলে নিয়েছেন লুনার স্বামী বিএনপি নেতা মকবুল।
গণঅভ্যুত্থানের পর লুনার স্বামী বিএনপি নেতা মকবুল ফ্যাসিবাদের সময়ের চাঁদাবাজ, একাধিক হত্যা মামলার আসামি, পলাতক নেতাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে পুনর্বাসন করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি বিপ্লব সরকারের মালিকানাধীন ৫ আগস্টের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া ইসলামিয়া মার্কেটের ১২টি দোকান খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করে মকবুল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এসব দোকান খোলার জন্য লুনা কয়েক কোটি টাকা নিয়েছে।
নিউ মার্কেটের প্রায় ৭০ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে গণমাধ্যম রিপোর্ট করেছে, হত্যা মামলার আসামি বিপ্লব নীলক্ষেত ইসলামিয়া মার্কেটের দোকানগুলো থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার বেশি মালামাল ও অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলে। আওয়ামী লীগের পতনের পর কিছু ব্যবসায়ী সমিতির কাছে তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব তুলে ধরে তা উদ্ধারের জন্য আবেদন করে। এ ঘটনায় ব্যবসায়ী ও সমিতির সমন্বয়ে বিপ্লবের ১২ দোকান বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু লুনা তার স্বামীর সহায়তায় বিপ্লবের সব দোকান খুলে দেয় ব্যবসায়ীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার শর্তে। কিন্তু দোকান খুলে দেওয়ার পরপরই কেউ অর্থ ফেরত চাইলে মকবুল হোসেন ব্যবসায়ীদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। কয়েকজনকে সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হলেও বাকিদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। কখনো কখনো বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের কথা বলে ব্যবসায়ীদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে মকবুল। ফলে ব্যবসায়ীরা ভয়ে চুপ হয়ে আছেন।
ডলফিন বুকস হাউসের স্বত্বাধিকারী রাফি গণমাধ্যমকে বলেন বলেন, বিপ্লব সরকার আওয়ামী লীগের আমলে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসাবে আড়াই লাখ টাকা নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। এরপর বিভিন্ন সময় তার স্টাফদের দিয়ে বই, নগদ টাকা নিয়ে গেছে। এখন আমরা তা চাইতে গেলে মকবুল হোসেন ৫০ হাজার টাকা অফার করে বলে, এটাই পাবা, নিলে নাও না নিলে যাও। এরপর আমরা সেনাবাহিনী ও পুলিশের কাছেও যাই। তাতে হুমকি-ধমকি ছাড়া কিছু পাইনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, তারা সায়েন্সল্যাব এলাকার সেনাবাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডারের কাছে বিপ্লব, মকবুল ও লুনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল মেলেনি।
মকবুল বাহিনীর বেপরোয়া চাঁদাবাজি
আওয়ামী লীগের পতনের পর নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী চাঁদাবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওই এলাকাসহ বিভিন্ন মার্কেটের দোকান দখল, চাঁদাবাজি, অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মার্কেটে পুনর্বাসন এবং বিদ্যুৎ বিলের নামে চাদাঁবাজিসহ বিভিন্ন অজুহাতে হাজার হাজার ব্যবসায়ীকে জিম্মি করে রেখেছে তার বাহিনী।
ব্যবসায়ীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শুধু নিউ মার্কেটের ফুটপাত থেকেই দিনে কমপক্ষে ছয় লাখ টাকা চাঁদা তোলে মকবুল। এজন্য সে চাঁদা তোলা বাহিনীও গড়ে তুলেছেন। মার্কেটের অভ্যন্তরেই ফুটপাতে প্রায় ৫০০ দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকান থেকে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ বিল হিসেবে দুই হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এছাড়াও নিউ মার্কেটের ফুটপাতে পার্কিংয়ের জন্য প্রতিটি গাড়ি বাবদ ২০ টাকা করে আদায় করা হচ্ছে। এসব চাঁদার রসিদে সিটি করপোরেশনের লোগো থাকলেও সেখানে তা জমা হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, নিউ মার্কেটের অভ্যন্তরে ফুটপাতের ১৫০টি দোকান দখলে নিয়ে ভাড়া দিয়েছে মকবুল বাহিনী। প্রতিটি দোকানের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার এবং অগ্রিম হিসাবে নেওয়া হয়েছে তিন লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন হকার জানিয়েছেন, পুরো নিউ মার্কেট এলাকায় ফুটপাতে ৮০০ থেকে ৮৫০ জন হকার রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছে থেকে মাসে ভাড়া বাবদ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা তুলে নিচ্ছে মকবুলের লোকজন। এ অর্থ কোথায় যায় এবং কী হয়, তা তারা জানেন না।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিউ মার্কেটে মূল দোকান রয়েছে ৪২৬টি। এসব দোকানের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, তাদের কাছে থেকে বিদ্যুৎ বিলের জন্য প্রতি মাসে আট হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা করে তোলা হয়। অর্থাৎ ফুটপাত ও মূল দোকান থেকে ৬০ লাখ টাকার মতো টাকা তোলে মকবুলের লোকজন। কিন্তু প্রকৃত বিদ্যুৎ বিল এত বেশি নয়, ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকার মতো হতে পারে। এভাবে বাকি অর্থ মকবুল বাহিনী লুটে নিচ্ছে।
এই চাঁদার ভাগ মকবুল পৌঁছে দেয় দক্ষিণ বিএনপির কিছু নেতা, একজন আইনজীবীর কাছে এবং স্থানীয় থানায়।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের পতনের পর নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির অফিস দখল করে নেয় মকবুল। এরপর নিজেকে ঘোষণা করে সমিতির আহ্বায়ক। সম্প্রতি কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশনের দুটি দোকান ঢাকা দক্ষিণ সিটির কর্মকর্তাদের সহায়তায় নকল দলিল তৈরি করে বিক্রি করে দিয়েছে।
ডিএসসিসি ও বিএনপি মহাসচিবের কাছে নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির অভিযোগ
নিউ মার্কেটে দখল ও চাঁদাবাজির সার্বিক বিষয় তুলে ধরে সমিতির সভাপতি লিপিকা দাসগুপ্তা চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল মকবুলের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে চিঠি দেয়। চিঠি দেওয়া হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশেনেও। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তথ্যসূত্র:
১. বিএনপি-আ.লীগের যৌথ চাঁদাবাজিতে দিশাহারা নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা
– https://tinyurl.com/2xsehxez


